কাযযাবগং তথা উলামায়ে সূ’দের মিথ্যাচারিতার দাঁতভাঙ্গা জবাব ২৪
« পূর্ব প্রকাশের
পর
পরিশিষ্ট
মহান আল্লাহ পাক তিনি দুনিয়ালোভী পথভ্রষ্ট উলামায়ে ‘ছূ’দের কালো থাবা
থেকে দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান ও আমল হিফাযতের লক্ষ্যে শতবছর পর পর বিশেষ
হাদী হিসেবে মুজাদ্দিদ উনাদেরকে যমীনে পাঠিয়ে থাকেন। মুজাদ্দিদ উনারা যখন তাজদীদ
শুরু করেন। অর্থাৎ উলামায়ে ছূ কর্তৃক দ্বীন ইসলামে প্রবেশকৃত সকল কুফরী শিরকী ও
বিদয়াতী আমলের মূলোৎপাটন করে, সঠিক আক্বীদা ও
আমলসহ অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়েই শরীয়তের সঠিক ও নির্ভুল ফায়ছালা তুলে ধরেন, তখনই দুনিয়ালোভী, পথভ্রষ্ট উলামায়ে ছূদের আতে ঘা লাগে এবং
তাদের দুনিয়া হাছিলের ব্যবসার পথ হয়ে যায় পরিপূর্ণরূপে রুদ্ধ। তাদের জিহালতী, ধোকাবাজী, বদ আক্বীদা-আমল ও ধর্মব্যবসায়ী চেহারা জনগণের নিকট হয়ে উঠে
স্পষ্ট। সঙ্গত কারণেই তখন তারা তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে যামানার মুজাদ্দিদ
উনাদেরকে।
ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ও জনরোষ থেকে রেহাই পেতে উলামায়ে ‘ছূ’রা তখন যামানার মুজাদ্দিদ উনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। এক্ষেত্রে তারা যামানার মুজাদ্দিদ উনার সঠিক বক্তব্যগুলোকে কাটছাট ও অপব্যাখ্যা করে জনসম্মুখে উপস্থাপন করে জনগণকে মুজাদ্দিদ উনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। পূর্ববর্তী সকল মুজাদ্দিদ উনাদের জীবনীতেই এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে যামানার উলামায়ে ছূরা অর্থাৎ আবুল ফযল, ফৈজী, মোল্লা মুবারক নাগরী গং তাদের ধর্ম ব্যবসাভিত্তিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতি বাদশাহ ও জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে উনার অনেক বক্তব্যকে কাটছাট করে ও অপব্যাখ্যা করে বাদশাহ ও জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। এ সম্পর্কিত কিছু প্রমাণ উনার জীবনীগ্রন্থ থেকে হুবহু নিম্নে তুলে ধরা হলো-
“সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের অসীম প্রভাবের দরুন বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজদরবারে রাফেযীদের প্রভাব অতিশয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এই মাযহাবের বিরুদ্ধে কতিপয় পুস্তক পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। যার ফলে এই সম্প্রদায় উনার ঘোর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। তারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জব্দ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলো। তারা সুযোগ বুঝে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কর্তৃক হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে লিখিত একটি পত্র বাদশাহর সম্মুখে পেশ করে বাদশাহকে বুঝিয়ে দিল যে, শায়খ আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি নিজেকে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন এবং তিনি বলেন যে, উনার মাক্বাম হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বাম হতে উচ্চে।
উক্ত পত্রখানির অংশ বিশেষ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো-
“দ্বিতীয়বার এই মাক্বাম অবলোকন করার সময় আরও অনেক মাক্বাম দৃষ্টিগোচর হয়, যার একটি অন্যটি হতে উচ্চ ছিল। যখন ওটা হতে অধিকতর উচ্চ মাক্বামে পৌঁছলাম তখন বুঝলাম এই মাক্বামটি হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার এবং খলীফাগণও এই মাক্বাম অতিক্রম করেছেন। এ স্থান হতে অধিক উচ্চ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বাম যাহির হলো। এ স্থানেও এসে পৌঁছলাম।
খাজা বুযূর্গ হযরত শাহ নকশবন্দ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে প্রত্যেক স্থানে এভাবে আমার সঙ্গীরূপে দেখলাম যেন মাত্র অতিক্রম করার তফাৎ ছিল। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বাম হতে উচ্চ কোন মাক্বাম বুঝতে পারিনি। অবশ্য নবুওওয়াতের মাক্বাম অত্যন্ত বুলন্দ ও উচ্চ ছিল। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বামের বরাবর আর একটি অতি উত্তম ও বহুত নূরানী মাক্বাম দৃষ্টিগোচর হয়, যা হতে অধিক উত্তম অন্য কোন মাক্বাম দৃষ্টিগোচর হয়নি। মাক্বামে ছিদ্দীক্বী উচ্চ হয়ে থাকে। আমি জানতে পারলাম যে, এটা মাহবুবিয়াতের মাক্বাম। এ মাক্বামটি রঙ্গিন ও নকশা খচিত ছিল। এই মাক্বামের প্রতিচ্ছায়া পড়িবার দরুন এই বান্দা নিজকে রঙ্গিন ও উক্ত নকশায় নিজেকে খচিত দেখল। তৎপর রঙ্গিন ও নকশা খচিত এই অবস্থা সত্ত্বেও আমি নিজকে বড়ই সুক্ষ্ম (লতীফ) অনুভব করতে লাগলাম এবং বাতাস ও মেঘের টুকরার ন্যায় নিজকে বড়ই আকাশের চক্রবালে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় অনুভব করতে লাগলাম। এই অবস্থায় এক প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলাম। হযরত খাজা বুযূর্গ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি মাক্বামে ছিদ্দীক্বের মধ্যে রইলেন এবং আমি নিজেকে এর বরাবরের মাক্বামে উল্লেখিত অবস্থায় দেখতে লাগলাম।” (মকতুব নং ১১, দফতর-১)
এ পত্রখানা পেশ করার দরুন বাদশাহ জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উত্তরে বললেন, “আহলে সুন্নতগণ উনাদের নিকট যেমন ঐ ব্যক্তি সুন্নী নন যিনি হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনাকে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন; অনুরূপভাবে ছূফীগণের নিকটও ঐ ব্যক্তি ছূফী নন, যিনি নিজকে সৃষ্ট জীবের মধ্যে নিকৃষ্ট কুকুর হতে ভালো মনে করেন। অতএব আমি নিজকে কিরূপে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতে পারি। পীরের তাওয়াজ্জুহের দরুন সালিকগণ কিরূপে এক মাক্বাম হতে অন্য মাক্বামে ভ্রমণ করে ও উন্নীত হয় তার বর্ণনা এ মকতুবে উল্লেখ করা হয়েছে। সালিকগণের উরুজ বা উত্থান এরূপ মাক্বামে অল্প সময়ের জন্য হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, শাহী দরবারে আমীরগন রাত দিন হাজির থাকেন। যদি কোন সময় প্রয়োজনবশত বা অন্য কোন অজুহাতের দরুন বাদশাহ কোন সিপাহীকে তলব করে তার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তাকে সম্মানিত করেন, তাহলে এটা একটি অস্থায়ী ব্যাপার। ক্ষণিক পরেই সিপাহী নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করে এবং দরবারী স্বীয় বুলন্দ মাক্বামেই অবস্থান করেন। এই অস্থায়ী নৈকট্যের দরুন সিপাহীর মর্যাদা বাদশাহের অমাত্যগণ হতে উচ্চ মনে করা যেতে পারে না।
এভাবে আমাদের উরুজ বা উত্থান একটি সাময়িক অবস্থা। এ অবস্থা শেষ হওয়ার পর আমি পুন সিরহিন্দে পুরাতন পর্ণ কুটিরেই ফিরে আসি। এই হাক্বীক্বতটি উপলব্ধি করার পর এই উচ্চ মাক্বামে ছিদ্দীকী অর্থাৎ ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণা করাও অসম্ভব।
ইহা ব্যতীত এই পত্রে ইহাও লিখিত আছে যে, “এই মাক্বামের প্রতিবিম্বের দরুন আমি নিজকে স্বয়ং রঙিন পাইলাম। সূর্যের আলো এবং ইহা হইতে আলোকপ্রাপ্ত হওয়াকে উদারহণস্বরূপ পেশ করা যাইতে পারে। সূর্য সূর্যই থাকে যমিনের উপর উহার আলোক পতিত হইলে যমিন আলোকিত হয়। কিন্তু যমিন কি ইহার কারণে সূর্যের সমকক্ষতার দাবি করিতে পারে?”
এইরূপ দলীল ও প্রমাণের দ্বারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বাদশাহকে বুঝাইবার পর বাদশাহ শান্ত হইলেন এবং উনাকে সসম্মানে বিদায় দান করিলেন। বিরোধীদলের জন্য এই পরাজয় বরদাশত যোগ্য ছিল না। তাহারা তখন অন্য ব্যবস্থা করিল।
বাদশাহর উজীর আছফজাহের সহিত হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মনোমালিন্য হওয়ায় উক্ত উজীর বাদশাহকে পরামর্শ দান করিলে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তরফ হইতে আপনার সাবধান থাকা উচিত। কেননা উনার প্রভাব কেবল হিন্দুস্থানে সীমাবদ্ধ নহে বরং ইরান, তুরান, বদখশান প্রভৃতি স্থানেও বিদ্যমান। তিনি হাজার হাজার জীবন উৎসর্গকারী মুরীদ নিজের চতুর্দিকে একত্র করিয়াছেন। ভয় হয় পাছে সা¤্রাজ্যের মধ্যে উনারা কোন ফিতনার সৃষ্টি করেন কিনা। তিনি একজন অহংকারী ব্যক্তি। শাহ ইছমাইল ছফবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কেবল মুরীদগণের সহায়তায় ইরানের রাজত্ব আয়ত্তে আনয়ন করিয়াছিলেন। এমতাবস্থায় আপনার উচিত হইবে উনার খলীফা শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট সৈন্যদের গমনাগমন বন্ধ করিয়া দেওয়া এবং হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এই বিষয়ে বাধা সৃষ্টি করিলে উনাকে কয়েদ করা। ইহার পর শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট সৈন্যদের গমনাগমনের শাহী নিষেধাজ্ঞা জারি করা। হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিও শাহী সন্দেহের নেত্রে পতিত হইলেন। শায়খ ছাহিব সৈন্যদের হইতে পৃথক হইতে চাহিলে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ইজাযত দান করিলেন না। শেষ পর্যন্ত বাদশাহর তরফ হইতে গুপ্তচর নিয়োগ করা হইল এবং শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের মধ্যে পত্রালাপ বন্ধ হইলো। শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পেরেশান হইয়া হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে হাজির হইলেন বটে। কিন্তু তিনি ইহাতে নারায হইলেন। কাজেই শায়খ ছাহিব পুনঃ স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করিলেন। ইহাতে বিরোধীদল সুযোগ লাভ করিল এবং বাদশাহকে বুঝাইয়া দিল যে, শায়খ ছাহিব হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট লশকরের পয়গাম লইয়া গমন করিয়াছিলেন। ফল কথা, উজীর নিপুণভাবে বাদশাহর র্কণকূহরে বিষবাণী ঢালিতে লাগিল এবং শাহী দরবারে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে শহীদ, জ্বালা-যন্ত্রণা, দেশান্তরিত করণ অথবা কয়েদ করণের পরামর্শ দিতে লাগিল।
এই পক্ষ বাদশাহকে আরো বুঝাইয়া দিল যে, হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিয়ত যে খারাপ (নাঊযুবিল্লাহ!) তার প্রমাণ এই যে, বাদশাহ সালামতের জন্য জায়িয বলিয়া মান্যকৃত সিজদায়ে তাযীমী পালন করিতে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি পূর্বেও বাদশাহকে সম্মান প্রদর্শণ করেন নাই। আপনি পরীক্ষা করিলে দেখিতে পাইবেন যে, তিনি শাহী দরবারে হাজির হইয়াও সিজদা অথবা মস্তক অবনত করিবেন না।
ধর্মীয় বিপদ অপেক্ষা রাজত্ব সম্পর্কীয় বিপদ বাদশাহের নিকট অধিকতর চিন্তার কারণ স্বরূপ হইয়াছিল। বিরোধীদল ইহার সহিত তাহাদের নিকট দুর্বোধ্য বলিয়া বিবেচিত কতিপয় মকতুবের অনুচ্ছেদ হেরফের করিয়া বাদশাহের নিকট পেশ করিল এবং কতিপয় উলামার ফতওয়াও বাদশাহর নজরে পড়িয়াছিল।
যাহার মধ্যে হযরত মাওলানা আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারও কতিপয় পাল্টা আক্রমণাত্তক প্রবন্ধ ছিল।
যাহা হউক, উল্লিখিত অবস্থাবলির প্রেক্ষিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিরোধীদের চক্রান্তে পড়িয়া যায় এবং শেষ পর্যন্ত উনাকে কয়েদ করিবার ইচ্ছা করে। বাদশাহ তদীয় মতলব হাসিল করিবার নিরাপত্তা নিবন্ধন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার হালকাভুক্ত সমুদয় উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে রাজধানী হইতে সরাইয়া দেন। বাদশাহ খান খানানকে দাক্ষিনাত্যে, সৈয়দ সদরে জাহানকে পূর্বদিকে, খান জাহান লোদীকে মালব দেশে, খান আযমকে গুজরাটে এবং মহাব্বত খানকে কাবুলের গভর্নর নিযুক্ত করিয়া প্রেরণ করেন। ইহার পর পত্র মারফত দ্বিতীয়বার হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে সিরহিন্দ হইতে শাহী দরবারে তলব করা হয়, উদ্দেশ্য ছিল সিজদা করান তথা শাহী আনুগত্যের যাচাই করা। কেননা ধর্মীয় বিপদ অপেক্ষা রাজত্ব সম্পর্কীয় বিপদ বাদশাহর নিকট অধিকতর চিন্তার কারণ হইয়াছিল।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি যথারীতি শাহী দরবারে উপস্থিত হইলেন। উজিরের কথায় আকায়েদ সম্পর্কীয় যে ভ্রান্ত ধারণা বাদশাহর অন্তঃকরণে স্থান লাভ করিয়াছিল তিনি তৎসমুদয় বিদূরিত করেন। কিন্তু তিনি সিজদায়ে তা’যীমী পালন করিতে বিশেষ দৃঢ়তা সহকারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এমনকি বাদশাহের সম্মুখে সামান্য অবনত হইয়া শাহী আদব রক্ষা করিতেও তিনি পছন্দ করিলেন না। কাজেই সমস্ত (দুনিয়াদার) আলিম বাদশাহ ও দরবারী ওমরাদের সন্তোষ বিধানে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে শহীদ করিবার ফতওয়া দেন।
কিন্তু বাদশাহ জাহাঙ্গীর কিছুটা সহিষ্ণুতার সহিত কর্ম সম্পাদন করিলেন। তিনি উল্লিখিত অবস্থাগুলির ফলস্বরূপ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে দুই বৎসরের জন্য কয়েদ করিবার হুকুম জারি করিয়া গোয়ালিয়র দুর্গে প্রেরণ করেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করিয়াছেন, “এই কয়েদ আমার নফসের সংশোধন কার্যে বিশেষ সহায়ক হইয়াছিল। …….” (হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ১ম খ- ২২২ পৃষ্ঠা)
ঠিক একইভাবে বর্তমান যামানার মুজাদ্দিদ মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম-উনার তাজদীদী ফতওয়ার কারণে যখন উলামায়ে ‘ছূ’দের ধর্মব্যবসায়ী চেহারা জনগণের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে, তখনই তারা উনার আক্বীদা ও আমলে ভুল না পেয়ে উনার সঠিক ও কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ সম্মত বক্তব্যসমূহ কাটছাঁট করে ও অপব্যাখ্যা করে বেঠিক ও কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ বিরোধী বলে জনসম্মুখে উপস্থাপন করার অপচেষ্টায় রত হয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ আপনারা এই কিতাবটিতেই পেয়েছেন। আপনারা আরো জানতে পেরেছেন যে, আশাদ্দুদ দরজার জাহিল, হেমায়েত উদ্দীন ওরফে কাযযাবুদ্দীন ও মহা কাযযাব সুলাইমান আলী ওরফে মুসাইলামাতুল কাযযাব তথা বর্তমান যামানায় উলামায়ে ‘ছূ’রা তাদের রেসালায় রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার মুবারক লিখনী ও মাসিক আল বাইয়্যিনাতে প্রকাশিত বক্তব্যসমূহ কিভাবে কাটছাঁট করে তাদের ইচ্ছেমতো সাজিয়ে ও অপব্যাখ্যা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তবে কোন সন্দেহ নেই যে, মহান আল্লাহ পাক-উনার রহমতে বর্তমান যামানার উলামায়ে ‘ছূ’ কাযযাবুদ্দীন গংদের সকল প্রকার মিথ্যা, অপপ্রচার ও অপব্যাখ্যার বিষ দাঁত ভেঙে দেয়ার জন্য এই কিতাবটিই যথেষ্ট, যদিও কলেবর বৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কায় প্রতিটি বিষয় অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। তবে প্রয়োজনে বিস্তারিতভাবে তাদের মিথ্যাচারিতা ও ভণ্ডামির জবাব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো, কাযযাবুদ্দীন গংদেরকে বহু বার ওয়াজ-মাহফিলে, পত্র-পত্রিকা ও লিফলেট-হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে প্রকাশ্য বাহাছের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে যে, “যদি সত্যবাদী হয়ে থাক এবং বুকে যদি সাহস থাকে, ইলমের যদি এতোই জোর থেকে থাকে তবে প্রকাশ্য ময়দানে জনগণের সামনে এসে দলীল দ্বারা প্রমাণ করে দেখাও রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম-উনার কোন আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খিলাফ কিনা। যদি প্রমাণ করতে পার, তবে আমরা জনগণের সামনেই প্রকাশ্যে তওবা করবো, আর যদি তোমাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খিলাফ প্রমাণিত হয়, তবে তোমাদেরকেও প্রকাশ্যে জনগণের সামনে তওবা করতে হবে।” কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা বাহাছের ডাকে সাড়া দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। তাই এ কিতাবের মাধ্যমে তাদেরকে আবারো আহ্বান জানানো হলো, এ কিতাবে বর্ণিত বিষয়বস্তুসহ যে কোন বিষয়ে, যে কোন স্থানে, যে কোন সময়ে আমরা বাহাছ করতে রাজি আছি ইনশাআল্লাহ। কারণ আমরা চাই হক্ব প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করুক। আর নাহক্ব বা বাতিল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদেরকে হক্ব বুঝার, মানার ও হক্বের উপর ক্বায়িম-দায়িম থাকার এবং বাতিল প্রতিরোধ ও নিশ্চিহ্ন করার সহযোগিতা প্রদানের তাওফিক দান করুন। আমীন।
ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ও জনরোষ থেকে রেহাই পেতে উলামায়ে ‘ছূ’রা তখন যামানার মুজাদ্দিদ উনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। এক্ষেত্রে তারা যামানার মুজাদ্দিদ উনার সঠিক বক্তব্যগুলোকে কাটছাট ও অপব্যাখ্যা করে জনসম্মুখে উপস্থাপন করে জনগণকে মুজাদ্দিদ উনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। পূর্ববর্তী সকল মুজাদ্দিদ উনাদের জীবনীতেই এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে যামানার উলামায়ে ছূরা অর্থাৎ আবুল ফযল, ফৈজী, মোল্লা মুবারক নাগরী গং তাদের ধর্ম ব্যবসাভিত্তিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতি বাদশাহ ও জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে উনার অনেক বক্তব্যকে কাটছাট করে ও অপব্যাখ্যা করে বাদশাহ ও জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। এ সম্পর্কিত কিছু প্রমাণ উনার জীবনীগ্রন্থ থেকে হুবহু নিম্নে তুলে ধরা হলো-
“সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের অসীম প্রভাবের দরুন বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজদরবারে রাফেযীদের প্রভাব অতিশয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এই মাযহাবের বিরুদ্ধে কতিপয় পুস্তক পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। যার ফলে এই সম্প্রদায় উনার ঘোর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। তারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জব্দ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলো। তারা সুযোগ বুঝে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কর্তৃক হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে লিখিত একটি পত্র বাদশাহর সম্মুখে পেশ করে বাদশাহকে বুঝিয়ে দিল যে, শায়খ আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি নিজেকে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন এবং তিনি বলেন যে, উনার মাক্বাম হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বাম হতে উচ্চে।
উক্ত পত্রখানির অংশ বিশেষ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো-
“দ্বিতীয়বার এই মাক্বাম অবলোকন করার সময় আরও অনেক মাক্বাম দৃষ্টিগোচর হয়, যার একটি অন্যটি হতে উচ্চ ছিল। যখন ওটা হতে অধিকতর উচ্চ মাক্বামে পৌঁছলাম তখন বুঝলাম এই মাক্বামটি হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার এবং খলীফাগণও এই মাক্বাম অতিক্রম করেছেন। এ স্থান হতে অধিক উচ্চ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বাম যাহির হলো। এ স্থানেও এসে পৌঁছলাম।
খাজা বুযূর্গ হযরত শাহ নকশবন্দ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে প্রত্যেক স্থানে এভাবে আমার সঙ্গীরূপে দেখলাম যেন মাত্র অতিক্রম করার তফাৎ ছিল। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বাম হতে উচ্চ কোন মাক্বাম বুঝতে পারিনি। অবশ্য নবুওওয়াতের মাক্বাম অত্যন্ত বুলন্দ ও উচ্চ ছিল। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার মাক্বামের বরাবর আর একটি অতি উত্তম ও বহুত নূরানী মাক্বাম দৃষ্টিগোচর হয়, যা হতে অধিক উত্তম অন্য কোন মাক্বাম দৃষ্টিগোচর হয়নি। মাক্বামে ছিদ্দীক্বী উচ্চ হয়ে থাকে। আমি জানতে পারলাম যে, এটা মাহবুবিয়াতের মাক্বাম। এ মাক্বামটি রঙ্গিন ও নকশা খচিত ছিল। এই মাক্বামের প্রতিচ্ছায়া পড়িবার দরুন এই বান্দা নিজকে রঙ্গিন ও উক্ত নকশায় নিজেকে খচিত দেখল। তৎপর রঙ্গিন ও নকশা খচিত এই অবস্থা সত্ত্বেও আমি নিজকে বড়ই সুক্ষ্ম (লতীফ) অনুভব করতে লাগলাম এবং বাতাস ও মেঘের টুকরার ন্যায় নিজকে বড়ই আকাশের চক্রবালে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় অনুভব করতে লাগলাম। এই অবস্থায় এক প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলাম। হযরত খাজা বুযূর্গ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি মাক্বামে ছিদ্দীক্বের মধ্যে রইলেন এবং আমি নিজেকে এর বরাবরের মাক্বামে উল্লেখিত অবস্থায় দেখতে লাগলাম।” (মকতুব নং ১১, দফতর-১)
এ পত্রখানা পেশ করার দরুন বাদশাহ জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উত্তরে বললেন, “আহলে সুন্নতগণ উনাদের নিকট যেমন ঐ ব্যক্তি সুন্নী নন যিনি হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনাকে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন; অনুরূপভাবে ছূফীগণের নিকটও ঐ ব্যক্তি ছূফী নন, যিনি নিজকে সৃষ্ট জীবের মধ্যে নিকৃষ্ট কুকুর হতে ভালো মনে করেন। অতএব আমি নিজকে কিরূপে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতে পারি। পীরের তাওয়াজ্জুহের দরুন সালিকগণ কিরূপে এক মাক্বাম হতে অন্য মাক্বামে ভ্রমণ করে ও উন্নীত হয় তার বর্ণনা এ মকতুবে উল্লেখ করা হয়েছে। সালিকগণের উরুজ বা উত্থান এরূপ মাক্বামে অল্প সময়ের জন্য হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, শাহী দরবারে আমীরগন রাত দিন হাজির থাকেন। যদি কোন সময় প্রয়োজনবশত বা অন্য কোন অজুহাতের দরুন বাদশাহ কোন সিপাহীকে তলব করে তার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তাকে সম্মানিত করেন, তাহলে এটা একটি অস্থায়ী ব্যাপার। ক্ষণিক পরেই সিপাহী নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করে এবং দরবারী স্বীয় বুলন্দ মাক্বামেই অবস্থান করেন। এই অস্থায়ী নৈকট্যের দরুন সিপাহীর মর্যাদা বাদশাহের অমাত্যগণ হতে উচ্চ মনে করা যেতে পারে না।
এভাবে আমাদের উরুজ বা উত্থান একটি সাময়িক অবস্থা। এ অবস্থা শেষ হওয়ার পর আমি পুন সিরহিন্দে পুরাতন পর্ণ কুটিরেই ফিরে আসি। এই হাক্বীক্বতটি উপলব্ধি করার পর এই উচ্চ মাক্বামে ছিদ্দীকী অর্থাৎ ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণা করাও অসম্ভব।
ইহা ব্যতীত এই পত্রে ইহাও লিখিত আছে যে, “এই মাক্বামের প্রতিবিম্বের দরুন আমি নিজকে স্বয়ং রঙিন পাইলাম। সূর্যের আলো এবং ইহা হইতে আলোকপ্রাপ্ত হওয়াকে উদারহণস্বরূপ পেশ করা যাইতে পারে। সূর্য সূর্যই থাকে যমিনের উপর উহার আলোক পতিত হইলে যমিন আলোকিত হয়। কিন্তু যমিন কি ইহার কারণে সূর্যের সমকক্ষতার দাবি করিতে পারে?”
এইরূপ দলীল ও প্রমাণের দ্বারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বাদশাহকে বুঝাইবার পর বাদশাহ শান্ত হইলেন এবং উনাকে সসম্মানে বিদায় দান করিলেন। বিরোধীদলের জন্য এই পরাজয় বরদাশত যোগ্য ছিল না। তাহারা তখন অন্য ব্যবস্থা করিল।
বাদশাহর উজীর আছফজাহের সহিত হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মনোমালিন্য হওয়ায় উক্ত উজীর বাদশাহকে পরামর্শ দান করিলে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তরফ হইতে আপনার সাবধান থাকা উচিত। কেননা উনার প্রভাব কেবল হিন্দুস্থানে সীমাবদ্ধ নহে বরং ইরান, তুরান, বদখশান প্রভৃতি স্থানেও বিদ্যমান। তিনি হাজার হাজার জীবন উৎসর্গকারী মুরীদ নিজের চতুর্দিকে একত্র করিয়াছেন। ভয় হয় পাছে সা¤্রাজ্যের মধ্যে উনারা কোন ফিতনার সৃষ্টি করেন কিনা। তিনি একজন অহংকারী ব্যক্তি। শাহ ইছমাইল ছফবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কেবল মুরীদগণের সহায়তায় ইরানের রাজত্ব আয়ত্তে আনয়ন করিয়াছিলেন। এমতাবস্থায় আপনার উচিত হইবে উনার খলীফা শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট সৈন্যদের গমনাগমন বন্ধ করিয়া দেওয়া এবং হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এই বিষয়ে বাধা সৃষ্টি করিলে উনাকে কয়েদ করা। ইহার পর শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট সৈন্যদের গমনাগমনের শাহী নিষেধাজ্ঞা জারি করা। হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিও শাহী সন্দেহের নেত্রে পতিত হইলেন। শায়খ ছাহিব সৈন্যদের হইতে পৃথক হইতে চাহিলে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ইজাযত দান করিলেন না। শেষ পর্যন্ত বাদশাহর তরফ হইতে গুপ্তচর নিয়োগ করা হইল এবং শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের মধ্যে পত্রালাপ বন্ধ হইলো। শায়খ বদিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পেরেশান হইয়া হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে হাজির হইলেন বটে। কিন্তু তিনি ইহাতে নারায হইলেন। কাজেই শায়খ ছাহিব পুনঃ স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করিলেন। ইহাতে বিরোধীদল সুযোগ লাভ করিল এবং বাদশাহকে বুঝাইয়া দিল যে, শায়খ ছাহিব হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট লশকরের পয়গাম লইয়া গমন করিয়াছিলেন। ফল কথা, উজীর নিপুণভাবে বাদশাহর র্কণকূহরে বিষবাণী ঢালিতে লাগিল এবং শাহী দরবারে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে শহীদ, জ্বালা-যন্ত্রণা, দেশান্তরিত করণ অথবা কয়েদ করণের পরামর্শ দিতে লাগিল।
এই পক্ষ বাদশাহকে আরো বুঝাইয়া দিল যে, হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিয়ত যে খারাপ (নাঊযুবিল্লাহ!) তার প্রমাণ এই যে, বাদশাহ সালামতের জন্য জায়িয বলিয়া মান্যকৃত সিজদায়ে তাযীমী পালন করিতে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি পূর্বেও বাদশাহকে সম্মান প্রদর্শণ করেন নাই। আপনি পরীক্ষা করিলে দেখিতে পাইবেন যে, তিনি শাহী দরবারে হাজির হইয়াও সিজদা অথবা মস্তক অবনত করিবেন না।
ধর্মীয় বিপদ অপেক্ষা রাজত্ব সম্পর্কীয় বিপদ বাদশাহের নিকট অধিকতর চিন্তার কারণ স্বরূপ হইয়াছিল। বিরোধীদল ইহার সহিত তাহাদের নিকট দুর্বোধ্য বলিয়া বিবেচিত কতিপয় মকতুবের অনুচ্ছেদ হেরফের করিয়া বাদশাহের নিকট পেশ করিল এবং কতিপয় উলামার ফতওয়াও বাদশাহর নজরে পড়িয়াছিল।
যাহার মধ্যে হযরত মাওলানা আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারও কতিপয় পাল্টা আক্রমণাত্তক প্রবন্ধ ছিল।
যাহা হউক, উল্লিখিত অবস্থাবলির প্রেক্ষিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিরোধীদের চক্রান্তে পড়িয়া যায় এবং শেষ পর্যন্ত উনাকে কয়েদ করিবার ইচ্ছা করে। বাদশাহ তদীয় মতলব হাসিল করিবার নিরাপত্তা নিবন্ধন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার হালকাভুক্ত সমুদয় উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে রাজধানী হইতে সরাইয়া দেন। বাদশাহ খান খানানকে দাক্ষিনাত্যে, সৈয়দ সদরে জাহানকে পূর্বদিকে, খান জাহান লোদীকে মালব দেশে, খান আযমকে গুজরাটে এবং মহাব্বত খানকে কাবুলের গভর্নর নিযুক্ত করিয়া প্রেরণ করেন। ইহার পর পত্র মারফত দ্বিতীয়বার হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে সিরহিন্দ হইতে শাহী দরবারে তলব করা হয়, উদ্দেশ্য ছিল সিজদা করান তথা শাহী আনুগত্যের যাচাই করা। কেননা ধর্মীয় বিপদ অপেক্ষা রাজত্ব সম্পর্কীয় বিপদ বাদশাহর নিকট অধিকতর চিন্তার কারণ হইয়াছিল।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি যথারীতি শাহী দরবারে উপস্থিত হইলেন। উজিরের কথায় আকায়েদ সম্পর্কীয় যে ভ্রান্ত ধারণা বাদশাহর অন্তঃকরণে স্থান লাভ করিয়াছিল তিনি তৎসমুদয় বিদূরিত করেন। কিন্তু তিনি সিজদায়ে তা’যীমী পালন করিতে বিশেষ দৃঢ়তা সহকারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এমনকি বাদশাহের সম্মুখে সামান্য অবনত হইয়া শাহী আদব রক্ষা করিতেও তিনি পছন্দ করিলেন না। কাজেই সমস্ত (দুনিয়াদার) আলিম বাদশাহ ও দরবারী ওমরাদের সন্তোষ বিধানে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে শহীদ করিবার ফতওয়া দেন।
কিন্তু বাদশাহ জাহাঙ্গীর কিছুটা সহিষ্ণুতার সহিত কর্ম সম্পাদন করিলেন। তিনি উল্লিখিত অবস্থাগুলির ফলস্বরূপ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে দুই বৎসরের জন্য কয়েদ করিবার হুকুম জারি করিয়া গোয়ালিয়র দুর্গে প্রেরণ করেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করিয়াছেন, “এই কয়েদ আমার নফসের সংশোধন কার্যে বিশেষ সহায়ক হইয়াছিল। …….” (হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ১ম খ- ২২২ পৃষ্ঠা)
ঠিক একইভাবে বর্তমান যামানার মুজাদ্দিদ মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম-উনার তাজদীদী ফতওয়ার কারণে যখন উলামায়ে ‘ছূ’দের ধর্মব্যবসায়ী চেহারা জনগণের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে, তখনই তারা উনার আক্বীদা ও আমলে ভুল না পেয়ে উনার সঠিক ও কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ সম্মত বক্তব্যসমূহ কাটছাঁট করে ও অপব্যাখ্যা করে বেঠিক ও কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ বিরোধী বলে জনসম্মুখে উপস্থাপন করার অপচেষ্টায় রত হয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ আপনারা এই কিতাবটিতেই পেয়েছেন। আপনারা আরো জানতে পেরেছেন যে, আশাদ্দুদ দরজার জাহিল, হেমায়েত উদ্দীন ওরফে কাযযাবুদ্দীন ও মহা কাযযাব সুলাইমান আলী ওরফে মুসাইলামাতুল কাযযাব তথা বর্তমান যামানায় উলামায়ে ‘ছূ’রা তাদের রেসালায় রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার মুবারক লিখনী ও মাসিক আল বাইয়্যিনাতে প্রকাশিত বক্তব্যসমূহ কিভাবে কাটছাঁট করে তাদের ইচ্ছেমতো সাজিয়ে ও অপব্যাখ্যা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তবে কোন সন্দেহ নেই যে, মহান আল্লাহ পাক-উনার রহমতে বর্তমান যামানার উলামায়ে ‘ছূ’ কাযযাবুদ্দীন গংদের সকল প্রকার মিথ্যা, অপপ্রচার ও অপব্যাখ্যার বিষ দাঁত ভেঙে দেয়ার জন্য এই কিতাবটিই যথেষ্ট, যদিও কলেবর বৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কায় প্রতিটি বিষয় অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। তবে প্রয়োজনে বিস্তারিতভাবে তাদের মিথ্যাচারিতা ও ভণ্ডামির জবাব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো, কাযযাবুদ্দীন গংদেরকে বহু বার ওয়াজ-মাহফিলে, পত্র-পত্রিকা ও লিফলেট-হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে প্রকাশ্য বাহাছের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে যে, “যদি সত্যবাদী হয়ে থাক এবং বুকে যদি সাহস থাকে, ইলমের যদি এতোই জোর থেকে থাকে তবে প্রকাশ্য ময়দানে জনগণের সামনে এসে দলীল দ্বারা প্রমাণ করে দেখাও রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম-উনার কোন আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খিলাফ কিনা। যদি প্রমাণ করতে পার, তবে আমরা জনগণের সামনেই প্রকাশ্যে তওবা করবো, আর যদি তোমাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খিলাফ প্রমাণিত হয়, তবে তোমাদেরকেও প্রকাশ্যে জনগণের সামনে তওবা করতে হবে।” কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা বাহাছের ডাকে সাড়া দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। তাই এ কিতাবের মাধ্যমে তাদেরকে আবারো আহ্বান জানানো হলো, এ কিতাবে বর্ণিত বিষয়বস্তুসহ যে কোন বিষয়ে, যে কোন স্থানে, যে কোন সময়ে আমরা বাহাছ করতে রাজি আছি ইনশাআল্লাহ। কারণ আমরা চাই হক্ব প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করুক। আর নাহক্ব বা বাতিল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদেরকে হক্ব বুঝার, মানার ও হক্বের উপর ক্বায়িম-দায়িম থাকার এবং বাতিল প্রতিরোধ ও নিশ্চিহ্ন করার সহযোগিতা প্রদানের তাওফিক দান করুন। আমীন।
No comments