চন্দ্রদ্বিখন্ডিত হওয়ার ভারতীয় স্বাক্ষী রাজা চেরামান পেরুমল ওরফে তাজউদ্দীন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও উনার ইতিহাস।
চেরামান পেরুমল উপমহাদেশের সর্বপ্রথম নাগরিক যিনি পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন
এবং শেষ নবী হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং উনার পবিত্র
সাহচর্য লাভ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। উনার নিবাস ছিল ভারতের বর্তমান কেরালা
প্রদেশের মালাবার অঞ্চলের ’Kodungaloor
‘কোডুঙ্গোলর’
এলাকায়। উনি উক্ত অঞ্চলের সম্রাট ছিলেন। একাধারে ২৬টি বৎসর তিনি রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত
ছিলেন। পুরো দক্ষীণ ভারতের ২৫০০ মাইলেরও বেশী এলাকা জুড়ে উপকুলীয় এ রাজ্যের সীমানা
ছিল বিশাল। অনেক ঐতিহাসিক উনার ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রাচীন
বইয়ের মধ্যে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন হস্তলিপি থেকে (রেফারেন্স আরবি, ২৮০৪,
১৫২-১৭৩
ভলিউম ১৬ (০৬)) উদ্ধৃতি সহকারে এম. হামিদুল্লাহ রচিত “মুহম্মদ রসূলুল্লাহ” (ﷺ)
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
চেরামান পেরুমল নিজ অঞ্চলে থেকে ইসলামের শেষনবী হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা বা অলৌকিক ঘটনা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেণ। পবিত্র কুর’আনের সূরা-ক্বমার-এ এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের
মু’জেজার কথা উল্লেখ আছে। তাফসিরে মা’আরিফুল কুর’আনে উক্ত সূরার ব্যাখ্যায় এই ভারতীয়
সাহাবীর ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কথা উল্লেখ আছে। ওখানে আরো বলা আছে যে, মালাবারের এই মহারাজা ডায়েরী লিখতেন। যেদিন এই
চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা সংগঠিত সেই,
উনি
সেইদিনের ঘটনা সবিস্তারে তারিখ সহ লিখে গেছেন। উনার রচিত সেই ডায়েরী এখনও সংরক্ষিত
আছে।
জোৎস্নারাতে রাজা চেরুমল রাজপ্রসাদের ছাদে বসে ছিলেন রাণী সাথে করে। হঠাৎ চাঁদকে
দ্বিখন্ডিত হতে দেখে রাণীসহ তিনি ও তার সভাসদরা যারপরনাই বিষ্মত হন। এ বিষয়ে তিনি রাজজ্যোতিষীদের
কাছে জানতে চান। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই মালাবার উপকুলে আগত আরব বণীকদের মাধ্যমে স্থানীয়
আরব বণীক ও তাদের ভারতীয় দোসররা জানতে পারেন যে, মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আরবে একজন মহান নবী ও রসূল আত্বপ্রকাশ
করেছেন, তিনি একত্ববাদ প্রচার করেন, তিনিই নিজ হাতের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন।
এ কথা শুনে অভিভূত রাজা চেরামান পেরুমল আরবের সেই মহান রসূল উনার সাথে স্বাক্ষাতের
জন্য মরীয়া হয়ে উঠেন, শেষ পর্যন্ত তিনি
পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন একদল আরব বণীকদের সাথে।
হিজরতের পূর্বে সম্ভবত ৬১৯-৬২০ খৃষ্টাব্দে, ২৭ শে শাওয়াল সকাল নয়টার দিকে প্রিয় রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেখানেই তিনি স্বয়ং রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন।
প্রখ্যাত সাহাবী ছিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক আলাইহিস সালামসহ আরও কয়েকজন
সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উপস্থিতিতে স্বয়ং আল্লাহর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার নাম রাখে তাজউদ্দীন। রাজা চেরামান পেরুমল রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার জন্য উপঢৌকন হিসেবে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত আচার নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয়
এক বাদশাহ কর্তৃক আদার সংমিশ্রণে তৈরী সেই
আচার সংক্রান্ত একটা হাদিস শরীফও আমরা দেখতে পাই, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাইদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত
হয়েছে হাদিসটি।
হাদীস সঙ্কলনকারী হাকিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘মুস্তাদরাক’ নামক কিতাবে হাদীসটি
সঙ্কলন করেছেন। হাদীস শরীফের বর্ণনাকারী সাহাবী
হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু,
ভারতীয়
সাহাবী তাজউদ্দীন রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ‘মালিকুল হিন্দ’ তথা ‘ভারতীয় মহারাজ’ বলে সম্বোধন
করেন।
عن ابى
سعيد الخدرى (رضى لله عنه) قال اهدى ملك الهند الى النبى (صلى الله عليه وسلم) جرة
فيها زنجبيل فاطعم اصحابه قطعة قطعة واطعمنى منها قطعة
[رواه المستدرك حاكم]
হযরত আবু সাঈদ সা’দ বিন মালিক বিন সিনান আল খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘ভারতীয় মহারাজ রসূলপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার জন্য এক বয়াম আচার নিয়ে আসলেন যার মধ্যে আদার টুকরা ছিল। রসূলপাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই টুকরাগুলা উনার সাহাবীদের ভাগ করে দিলেন। আমিও খাবার জন্য একটি
টুকরা ভাগে পেয়েছিলাম’।
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মালিক ইবনে দীনার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার বোন রাজিয়া রদ্বিয়াল্লাহু
আনহা উনার সাথে রাজা পেরুমল তথা সাহাবী তাজউদ্দীন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার বিয়ে হয়।
তিনি সেখানে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ বৎসর অবস্থান করে রসূলপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক নির্দেশ মোতাবেক ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার সাথে মালিক
ইবনে দীনার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ আরও ক’জন সাহাবী ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে দক্ষিণপূর্ব
আরবের এক বন্দরে (বর্তমান ওমানের সালালা শহর) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই ইন্তেকাল
করেন। আজও উনার রওজা শরীফ ওমানের সালালা শহরে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। মর্যাদাবান এক
সাহাবী হিসেবে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সেটি এক অনবদ্য আকর্ষণ।
ওদিকে মালিক ইবনে দিনার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং উনার বোন রাজিয়া রদ্বিয়াল্লাহু
আনহাসহ অন্যান্য মুসলমানগণ ঠিক মতোই কেরালাতে পৌঁছেন, ইন্তেকাল আসন্ন বুঝতে পেরে চেরুমান পেরুমল তথা
তাজউদ্দীন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার আত্বীয়স্বজনদের কাছে চিঠি লিখে পাঠান সাহাবী মালিক
ইবনে দিনার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার হাতে।
সাহাবী মালিক ইবনে দিনারর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার বোন রাজিয়া দলবলসহ কেরালায় আসেন
এবং এখানেই তারা বসতী স্থাপন করেন। এর আগে থেকেই সেখানে এক বিরাট আরব বণীকদের বসতী
গড়ে উঠেছিল। সাহাবী মালিক ইবনে দিনার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেখানে ভারতের প্রথম মসজিদ
স্থাপন করেন। সেখানেই এই মহান সাহাবী ও উনার বোন হযরত রাজিয়া রদ্বিয়াল্লাহু আনহা উনাদের
রওজা শরীফ আজও বিদ্যমান রয়েছে।
হযরত তাজউদ্দীন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু (অর্থাৎ রাজা পেরুমল) ইন্তেকালের পূর্বে তৎকালীন
কোনডাংগালুর –এর রাজাকে (অর্থাৎ উনার ভাতিজাকে) একটি চিঠি দিয়ে যান। এই রাজাই হযরত
মালিক বিন দিনার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে পরবর্তীতে অরাথ্লি মন্দিরকে মসজিদে রুপান্তরিত
করায় সহযোগিতা করেন। এই মসজিদ পৃথিবীতে,
মসজিদ-এ
নববীর পর দ্বিতীয় জুমা মসজিদ হিসাবে আখ্যায়িত, যেখানে প্রায় সাড়ে তেরশ বছর ধরে জুমার নামাজ আদায় করা হচ্ছে।
এটি কোনডাংগালুর –এর মৃথলা গ্রামে অবস্থিত। সুবহান আল্লাহ।
সূত্রঃ
১. New York Islamic Center পেইজ।
No comments