কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস-৮
শহীদ পরিবার ও খন্ডিত মস্তক মুবারক দামেস্কে
প্রেরণ
এভাবে তিনদিন পর্যন্ত মস্তকসমূহ ও শহীদ
পরিবারের সদস্যগণকে ঘুরানোর পর ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিল, এবার এ মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে দামেস্কে ইয়াযীদের কাছে
নিয়ে যাও। ইবনে যিয়াদ আরো বলল যে, পথের মধ্যে কোন গ্রাম,
বাজার, কোন লোক বসতি সামনে পড়লে যেন
তাকবীর ইত্যাদি বলে শোরগোল করে যাওয়া হয়, যাতে লোকেরা
ভয় পায় এবং ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করার সাহস না পায়।
অতঃপর ইয়াযীদী বাহিনী মস্তক সমূহ বর্শায়
বিদ্ধ করে এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে উটের উপর উঠিয়ে কূফা থেকে দামেস্কের পথে
রওয়ানা দিল। চলতে চলতে রাত্রিবেলা এক গীর্জার সন্নিকটে উপনীত হলো। যে সময় এ
কাফেলা গীর্জার কাছে পৌঁছল, সে সময় গীর্জা থেকে
এর প্রধান পাদ্রী বের হয়ে ওদের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা
কে? কোথা থেকে আসতেছ? এ
মস্তকগুলো কাদের? এ মহিলাগণ কারা? তোমরা যাচ্ছ কোথায়? ঘটনা কি? তারা সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল। পাদ্রী সম্পূর্ণ ঘটনা শুনার পর বলল,
তোমরা চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, রাতটা
এখানেই কাটাও এবং এক রাতের জন্য হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক
মুবারকটি আমার কাছে আমানত রাখ এবং এসব পুত-পবিত্র মহিলাগণ যারা আছেন উনাদের খিদমত
করারও আমাকে সুযোগ দাও। ওরা বলল, তা কিছুতেই হতে পারে না।
সরকারের গুরু দায়িত্ব আমাদের কাঁধে অর্পণ করা হয়েছে। এ মস্তক আমরা কারো কাছে
দিতে পারি না। মস্তক ও এদেরকে ইয়াযীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। পাদ্রী বলল, ঠিক আছে পৌঁছাবে, কিন্তু এ রাত্রেতো আর
পৌঁছাতে পারবে না। ওরা বলল, আমরা এখানে রাত অতিবাহিত করতে
রাজী আছি। কিন্তু মস্তক দিতে রাজী নই। পাদ্রী বলল, আমার
থেকে টাকা নিয়ে হলেও এক রাত্রের জন্যে মস্তকটি আমার হিফাজতে দাও এবং আমি ওয়াদা
করছি, তোমাদের মস্তক ফিরিয়ে দিব। ওরা বলল, আমাদেরকে কত টাকা দিবেন? পাদ্রী বলল, আমার কাছে আমার সারা জীবনের উপার্জন আশি হাজার দিরহাম জমা রয়েছে। আমি
সব তোমাদেরকে দিয়ে দিব। তোমরা শুধু এক রাত্রের জন্যে মস্তকটি দাও। ওরা চিন্তা করল,
ইয়াযীদ থেকে তো বখশিশ পাবই, আর এদিকে
নগদ আশি হাজার দিরহাম হাতছাড়া করবো কেন? শেষ পর্যন্ত
তারা রাজী হয়ে গেল এবং এক রাত্রের জন্যে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
মস্তক মুবারকটি উক্ত পাদ্রীকে দিয়ে দিল।
পাদ্রী গীর্জার এক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন
কামরা আহলে বাইত-এর সম্মানিত সদস্যগণকে বিশ্রামের জন্য দিয়ে দিল এবং উনাদের খিদমত
করার জন্য কয়েকজন খাদিম নিয়োজিত করে তাদেরকে বলে দিল যেন উনাদের কোন কষ্ট না
হয়। আহলে বাইত-এর সদস্যগণ পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাদ্রী
সাহেব! আমাদের আগমনের খবর আপনি কিভাবে জানতে পারলেন? পাদ্রী
বলল, আমি ভিতরে বসা ছিলাম, তখন
আপনাদের কাফেলা বেশ কিছু দূরে ছিল, আমি হঠাৎ শুনলাম,
আমার গীর্জার বড় দেয়ালটা কাঁদছে। আমি আমার জীবনে এ রকম কান্না
আরও কয়েকবার শুনেছি। কান্না শুনার পর আমি বুঝতে পারলাম, কোন
একটা অঘটন ঘটেছে। তখন আমি বের হলাম, কি ঘটনা ঘটল তা দেখার
জন্য। তখন আমি আপনাদের কাফেলা দেখতে পেলাম। এবং সমস্ত ঘটনা শুনে বুঝতে পারলাম,
আপনাদের প্রতি অমানুষিক জুলুম করা হয়েছে। নবী মুস্তফা
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে নিদারুণ অত্যাচারের সাথে শহীদ করা
হয়েছে এ জন্যই বড় দেয়ালটা কাঁদছিল।
অতঃপর পাদ্রী উনাদেরকে ধৈর্যধারণের কথা
বললেন এবং বললেন, আল্লাহ তায়ালা’র নেক বান্দাগণের প্রতি এরকম মুছিবত আগেও এসেছে, বর্তমানেও আসছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। আপনাদেরকে ধৈর্য ও সহনশীলতার
পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের নাম কিয়ামত পর্যন্ত চির জাগরুক
রাখবেন।
এরপর পাদ্রী ইয়াযীদ বাহিনীকে আশি হাজার
দিরহাম দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক নিয়ে নিলেন।
মস্তক মুবারক নিয়ে তিনি তার উপাসনালয়ে চলে গেলেন। চেহারা মুবারকে যেসব রক্তের
দাগ ছিল, তিনি সব পরিষ্কার করলেন এবং নিজের কাছে যা সুগন্ধি ছিল
সব হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার চুল ও দাড়ী মুবারকে ঢেলে দিলেন এবং একটি
রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে উঁচু জায়গায় রাখলেন আর সারা রাত তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন ও
কান্না-কাটি করলেন। তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারকের
যথাসাধ্য যত্ন নিলেন এবং যথাযথ সম্মান করলেন।
মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতের শান দেখুন, সকাল বেলা পাদ্রীর মুখ থেকে কালিমা তাইয়্যিবাহ্ জারি হয়ে গেল। মস্তক
মুবারকের তা’যীম করার ফলে আল্লাহ তায়ালা উনাকে ঈমানী
দৌলত দ্বারা পরিতুষ্ট করলেন এবং তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। তিনি দুনিয়াবী দৌলত
ত্যাগ করলেন, আল্লাহ তায়ালা উনাকে ঈমানী দৌলত দান করলেন।
তিনি অস্থায়ী দৌলত (আশি হাজার দিরহাম) ব্যয় করলেন, আল্লাহ
তায়ালা এর বিনিময়ে উনাকে স্থায়ী দৌলত (ঈমান) দান করলেন।
সকালে ইয়াযীদী বাহিনী পবিত্র মস্তকসমূহ ও
শহীদ পরিবারের সদস্যগণকে নিয়ে পুনরায় রওয়ানা দিল। কিছু দূর যাওয়ার পর ইয়াযীদী
বাহিনী পরস্পর শলা-পরামর্শ করে পাদ্রী প্রদত্ত আশি হাজার দিরহাম তাদের মধ্যে বণ্টন
করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, ইয়াযীদ জানতে পারলে
সব দিরহাম নিয়ে নিতে পারে। সিদ্ধান্ত মুতাবিক বণ্টন করার জন্য যেইমাত্র দিরহামের
পুটলি খুলল, তখন দেখতে পেল সব মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা
এবং প্রতিটি টুকরার দুই পিঠে পবিত্র কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ লিখা। এক পিঠে লিখা
ছিল-
وسيعلم الذين ظلموا اى منقلب ينقلبون
অর্থ: ‘যুুলুমকারীরা
অতিসত্ত্বর জানতে পারবে, তারা কোন দিক হয়ে বসে আছে।’
(সূরা শুয়ারা-২২৭)
অপর পিঠে লিখা ছিল- ولاتحسبن الله غافلا عما يعمل الظالمون
অর্থ: ‘আল্লাহ
তায়ালাকে যালিমের কাজকর্মের প্রতি উদাসীন মনে করো না। যালিমরা যা কিছু করছে,
আল্লাহ তায়ালা সব জানেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে বেখবর মনে
করো না।’ (সূরা ইবরাহীম-৪২)
দেখুন, আশি
হাজার দিরহাম ওরা নিয়েছিল, কিন্তু তা মাটির পাত্রের
ভাঙ্গা টুকরা হয়ে গেল। তারাতো দ্বীনের পরিবর্তে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল,
সেটাতো বিফল হলো। কিন্তু যারা দুনিয়াকে অবজ্ঞা করে দ্বীনকে
আঁকড়িয়ে ধরে, দুনিয়াবাসী তাঁদের পিছনে ঝুঁকে পড়ে,
সম্পদ তাঁদের পদতলে গড়াগড়ি খায়।
ইয়াযীদের দরবারে শহীদ পরিবার ও ইয়াযীদের
ভন্ডামী
ইয়াযীদী বাহিনী আশি হাজার দিরহামের
অনুশোচনা করতে করতে দামেস্কে পৌঁছল এবং ইয়াযীদের দরবারে গিয়ে সমস্ত ঘটনার বিবরণ
দিল। ইয়াযীদ সমস্ত ঘটনা শুনে বলল, ইবনে যিয়াদ খুবই
বাড়াবাড়ি করেছে। আমি ওকে এতটুকু করতে বলিনি। এমনকি অনেক কিতাবে লিখা হয়েছে যে,
ইবনে যিয়াদের প্রতি ইয়াযীদ লা’নত
দিয়েছিল। অর্থাৎ সে বলেছিল, আল্লাহ তায়ালা ইবনে
যিয়াদের উপর লা’নত করুন। ইবনে যিয়াদ খুবই অত্যাচার
করেছে, আমার উদ্দেশ্য তা ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল,
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে যেন নজর বন্দী করে রাখা হয়,
যাতে লোকেরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে। কিন্তু এ ধরনের কথার
দ্বারা ইয়াযীদ রেহাই পেতে পারে না। যা কিছু হয়েছে ইয়াযীদের ইঙ্গিতেই হয়েছে। সে
ইবনে যিয়াদকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছিল যেন সে যা প্রয়োজন হয়, তা করে। যাতে তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠা বিদ্রোহ দমন হয়ে যায়। ইয়াযীদ
ভনিতাপূর্ণ দরদমাখা কথা-বার্তা এজন্যে বলেছিল, যাতে লোকজন
তার বিরুদ্ধে চলে না যায় এবং লোকেরা যেন মনে করে, সে এ
ধরনের আচরণ করার পক্ষপাতি ছিল না। এসব কথার কারণে অনেক লোক ইয়াযীদকে ভাল বলে
আখ্যায়িত করে তাদের রচিত কিতাবে লিখেছে যে, ‘ইয়াযীদ এ
শাহাদাতে রাজী ছিল না। সুতরাং, ইয়াযীদ নয় বরং ইবনে
যিয়াদই এ ঘটনার জন্য দায়ী।’
মূলতঃ এ ঘটনার জন্য ইয়াযীদই দায়ী ছিল।
যার কারণে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘কিতাবুল আক্বায়িদ’-এ লিখা হয়েছে, ইয়াযীদের উপর, ইবনে যিয়াদের উপর, আহলে বাইত-এর সদস্যগণের শহীদকারীদের উপর লা’নত
বর্ষিত হোক। যদি ইয়াযীদ নির্দোষ ও নিষ্পাপ হতো তাহলে হযরত ইমাম নাসাফী আলাইহিস
সালাম তাঁর ‘কিতাবুল আক্বায়িদ’-এ
এ ধরনের কথা কখনও লিখতেন না। আর ইয়াযীদের পরবর্তী পদক্ষেপে তার আসল রূপ আরো
স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতকিছু বলার পরও সে শহীদগণের মস্তক মুবারক গুলোকে রাতে
রাষ্ট্রীয় ভবনের শাহী দরজায় টাঙ্গানোর জন্য এবং দিনে দামেস্কের অলিতে-গলিতে
ঘুরানোর নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশ মত মস্তক মুবারকসমূহ দামেস্কের অলি-গলিতে
ঘুরানো হয়েছিল।
নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশিষ্ট
ছাহাবী হযরত মিনহাল বিন্ আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, খোদার কসম! আমি স্বচক্ষে দেখেছি যে, যখন হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে দামেস্কের
গলিতে এবং বাজারসমূহে ঘুরানো হচ্ছিল, তখন মিছিলের আগে আগে
এক ব্যক্তি কুরআন শরীফ-এর সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিল। যখন সে এ আয়াতে কারীমা-
ام حسبت ان اصحاب الكهف والرقيم كانوا من ايتنا عجبا
অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই
আছহাবে কাহাফ ও রক্বীম আমার নিদর্শনসমূহের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক নিদর্শন ছিল’
(সূরা কাহাফ-৯) পাঠ করছিল তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
উনার বিচ্ছিন্ন মস্তক মুবারক থেকে আওয়াজ বের হলো- اعجب من اصحاب الكهف قتلى وحملى
অর্থাৎ ‘আছহাবে কাহাফ-এর ঘটনা থেকে আমার শাহাদাত এবং আমার মস্তক
নিয়ে ঘুরাফেরা আরও অধিক আশ্চর্যজনক।’ আল্লাহ তায়ালা
ইরশাদ ফরমান- ولاتقولوا لمن يقتل فى سبيل الله اموات
‘যারা আমার রাস্তায় শহীদ হয়েছে, তাদেরকে
মৃত বলো না।’ (সূরা বাক্বারা-১৫৪) হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবরাক তা প্রমাণ করে দিল।
শহীদ পরিবারের মদীনা শরীফ প্রত্যাবর্তন
এরপর ইয়াযীদ হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তলব করল, যিনি একজন বিশিষ্ট ছাহাবী ছিলেন। উনাকে ডেকে বলল, আপনার সাথে আরো ত্রিশজন লোক নিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে বাহনযোগে
মদীনা মুনাওওয়ারায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসুন। হযরত নু’মান
বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ প্রস্তাবকে সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং নিজের
জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করলেন। অতঃপর ত্রিশজন সহকর্মীসহ হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে মদীনা মুনাওওয়ারার উদ্দেশ্যে
রওয়ানা হলেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত নু’মান বিন
বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললেন, আমাদেরকে
কারবালার পথ দিয়ে নিয়ে যান। আমরা দেখে যেতে চাই, আমাদের
শহীদদের দেহ মুবারক সেইভাবে পড়ে আছে, না কেউ দাফন করেছে।
যদি দাফনবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, প্রথমে আমরা তাঁদেরকে
দাফন করবো, এরপর ওখান থেকে রওয়ানা হবো। আর যদি কেউ দাফন
করে থাকে, তাহলে তা দেখে অন্ততঃ কিছুটা সান্ত¡না পাব। হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম-এর কথার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করলেন এবং
কারবালার পথ ধরলেন। কারবালায় গিয়ে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম সেই প্রান্তর যখন
দেখলেন, যেই প্রান্তরে উনাদের আপনজনদেরকে নির্মমভাবে শহীদ
করা হয়েছিল, হঠাৎ উনি অপ্রত্যাশিতভাবে চিৎকার করে উঠলেন
এবং অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, এখানে
হযরত আলী আছগরের দেহ মুবারক পড়েছিল, ওখানে হযরত আলী
আকবরের দেহ মুবারক পড়ে ছিল, এখানে আমার ভাই হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার দেহ মুবারক পড়েছিল। তিনি এভাবে যখন হাতের আঙ্গুল
দ্বারা দেখিয়ে দেখিয়ে দেহ মুবারকগুলোর অবস্থানের কথা বলছিলেন, তখন সবারই মুখ থেকে ক্রন্দনের করুণ আওয়াজ বের হচ্ছিল।
কারবালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম ছিল, যার নাম ছিল আমরিয়া। ইয়াযীদ বাহিনী চলে যাওয়ার পর ঐ আমরিয়া গ্রামের
অধিবাসীরা এসে শহীদদের দেহ মুবারকসমূহ দাফন করেছিল। মদীনা শরীফ থেকেও একটি দল হযরত
জাবির বিন আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নেতৃত্বে কারবালায় এসে
পৌঁছেছিল। শহীদ পরিবারের কাফেলা যখন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছল, সেই সময় মদীনা শরীফ থেকে আগত দল ও আমরিয়া গ্রামের অধিবাসীরাও উপস্থিত
ছিল। তারা যখন এ মজলুম কাফেলাকে দেখলো তখন আর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হল।
ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল ২০শে সফর অর্থাৎ শহীদদের ‘চেহলামের’
দিন। কাফেলার সবাই সেই রাত সেখানেই অতিবাহিত করেন। সারা রাত
তাঁরা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করেন, দুয়া-দুরূদ শরীফ পাঠ
করেন এবং খাবারের জন্য খিচুড়ী পাকান। আজকাল মুসলমানগণ যেরূপ কারো ইন্তিকালের পর
ফাতিহা পাঠ বা ঈছালে ছওয়াব উপলক্ষে খিচুড়ী বা অন্য তাবারুকের ব্যবস্থা করে
থাকেন। এটা মূলতঃ উনাদেরই স্মৃতিচারণ।
শহীদ পরিবার কারবালার প্রান্তরে একদিন এক
রাত অবস্থানের পর মদীনা মুনাওওয়ারার পথে রওয়ানা হলেন। কাফেলা যখন মদীনা
মুনাওওয়ারার সন্নিকটে পৌঁছল এবং চোখের সামনে মদীনা শরীফ-এর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল, তখন সবারই চোখ আবার অশ্রু সজল হয়ে উঠলো এবং একান্ত ধৈর্য ও ছবরের
পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অগ্রসর হলেন। এদিকে তাঁদের আগমনের খবর বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র
মদীনা মুনাওওয়ারায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
বড় মেয়ে হযরত ফাতিমা আলাইহিস সালাম আলাইহা মদীনা শরীফ-এ ছিলেন, যাঁর সাথে হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বড় ছেলের
বিবাহ হয়েছিল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ভাই হযরত মুহম্মদ বিন
হানাফিয়া আলাইহিস সালাম আলাইহিও মদীনা শরীফ-এ ছিলেন, হযরত
মুসলিম বিন আকিল আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর মেয়ে ও বোনেরাও তখন মদীনা শরীফ-এ ছিলেন।
নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আহলিয়া উম্মুল মু’মিনীন হযরত
উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাও মদীনা শরীফ-এ ছিলেন। উনারা সকলেই এবং
মদীনা শরীফ-এর প্রতিটি ঘরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রত্যেকেই মজলুম কাফেলাকে এক নজর
দেখার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড়
মেয়ে হযরত ফাতিমা আলাইহিস সালাম আলাইহা যখন মজলুম কাফেলাকে এগুতে দেখলেন, তখন একান্ত ছবর ও ধৈর্যশীলা হওয়া সত্ত্বেও অজান্তে হু হু করে কেঁদে
উঠলেন এবং ফুফু হযরত যয়নাব আলাইহাস সালামকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, ফুফু! আমার আব্বাজানকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার
ভাই আলী আছগর ও আলী আকবরকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার
চাচাতো ভাই ক্বাসিমকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার আব্বাস
চাচাজান কোথায়? আমাদের ভরপুর ঘর কোথায় লুণ্ঠিত হলো?
হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার সুশোভিত বাগানকে কারা
ছিন্নভিন্ন করলো? এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি
করতে লাগলেন তখন এমন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল যে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনেকে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন।
লোকেরা অনেক সান্তনা দিয়ে, ছবর ও ধৈর্যের কথা বলে
কাফেলাকে মদীনা শরীফ-এ নিয়ে আসলেন।
হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম উনার
রওজা শরীফ-এ উপস্থিতি
মজলুম কাফেলার সকলেই যখন কান্নায় ভেঙে
পড়লেন তখন কাফেলার একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস
সালাম শোকে পাথর হয়ে এক কিনারে দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই যখন উনাকে ঘরে যাওয়ার জন্য
জোর করলেন, তিনি বললেন, আমার আব্বাজান ওছীয়ত করেছেন, মদীনা শরীফ
পৌঁছে যেন সবার আগে তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওজা
শরীফ-এ হাজিরা দিই। তাই আমি রওজা পাকে যাওয়ার আগে কোথাও যাব না। অতঃপর তিনি রওজা
শরীফ-এ গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম যিনি এতক্ষণ পর্যন্ত ছবর
ও ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিশ্চুপ ছিলেন, তিনি রওজা
পাক-এর সামনে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শুধু এতটুকু বলতে পারছিলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দৌহিত্র হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সালাম গ্রহণ করুন। এরপর তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে
গেল এবং অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের দেখা কারবালার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করতে
লাগলেন। আর তাঁর কান্নার সাথে সাথে মদীনা শরীফ-এর সমস্ত দেয়াল থেকে কান্নার রোল
বের হচ্ছিল এবং রওজা মুবারকও থরথর করে কাঁপছিল এবং সেখান থেকে আওয়াজ বের হলো,
যাইনুল আবিদীন! তুমি আমাকে কী শুনাচ্ছ? আমি
তো সব কিছু স্বচক্ষে দেখেছি।
মদীনাবাসী হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন
আলাইহিস সালাম উনাকে ধৈর্য ধারণের কথা বললেন, আল্লাহ তায়ালা’র যা হুকুম ছিল, তা হয়েছে। নূরে মুজাস্সাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
সম্মানিতা আহলিয়া উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা
আলাইহাস সালাম তিনি বর্ণনা করেন, মদীনা শরীফ-এ একবার সেই
দিন ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেই দিন নূরে
মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালা’র সান্নিধ্যে গমন করেছিলেন।
আর একদিন ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হলো, যেদিন হযরত ইমাম
যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম কারবালা থেকে ফিরে এসেছেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আরো বর্ণনা করেন,
নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর দিন অদৃশ্য থেকে যেভাবে ক্রন্দনের আওয়াজ শুনা
গিয়েছিল, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের
সময় একইভাবে অদৃশ্য থেকে কান্নার আওয়াজ শুনা গিয়েছিল।
রওজা শরীফ-এ হাজিরা দিয়ে সমস্ত ঘটনা
বর্ণনা করার পর হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম ঘরে গেলেন এবং একান্ত ছবর ও
ধৈর্য সহকারে মদীনা শরীফ-এ অবস্থান করতে লাগলেন। হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস
সালাম-এর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, যখন তিনি পানি দেখতেন
সীমাহীন কান্নাকাটি করতেন এবং বলতেন, এই সেই পানি,
যা আলী আছগরের ভাগ্যে জোটেনি, হযরত আলী
আকবরের ভাগ্যে জোটেনি, আহলে বাইত-এর সদস্যদের জন্য বন্ধ
করে দেয়া হয়েছিল। উনার সামনে যখন খাবার আনা হতো তিনি দু’ এক লোকমা মুখে দিয়ে অবশিষ্টগুলো সামনে থেকে নিয়ে যেতে বলতেন। সবসময়
একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। সাধারণ লোকদের সাথে মেলামেশা করতেন না এবং যতদিন পর্যন্ত
জীবিত ছিলেন, কোনদিন হাসেননি। উনার ছেলে হযরত ইমাম
মুহম্মদ বাকির আলাইহিস সালাম একদিন উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আব্বাজান! কী ব্যাপার? আমি আপনাকে কোনদিন
হাসতে দেখিনি। তিনি বললেন, বৎস! আমার চোখের সামনে কারবালার
যে দৃশ্য ফুটে রয়েছে, তা দেখলে তোমার মুখ থেকেও চিরদিনের
জন্য হাসি বন্ধ হয়ে যেত! তুমিও সারা জীবনে কোনদিন হাসতে না। বৎস! আমি পুতঃপবিত্র
শরীর মুবারককে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখেছি, প্রিয় নবী
করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নকশা মুবারককে দাফন-কাফনবিহীন অবস্থায়
কারবালার প্রান্তরে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্রকে আঘাতে জর্জরিত হয়ে কারবালার তপ্ত বালি-রাশির উপর
দাফন-কাফনবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি।
হযরত উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন, এই পৃথিবীতে পাঁচজন ব্যক্তি খুব বেশি কান্নাকাটি করেছেন। তাঁরা হলেন-
এক. হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম, জান্নাত থেকে যমীনে তাশরীফ
আনার পর খুবই কান্নাকাটি করেছেন। দুই. হযরত ইয়াহ্ইয়া আলাইহিস্ সালাম, আল্লাহ তায়ালা’র ভয়ে খুবই কেঁদেছিলেন।
তিনি এত বেশি কান্নাকাটি করেছিলেন যে, দু’ গাল মুবারক বেয়ে চোখের পানি পড়তে পড়তে
চেহারা মুবারকে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিন. হযরত ইয়া’কূব
আলাইহিস সালাম, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর বিচ্ছেদের
কারণে খুবই কেঁদেছিলেন এবং অজস্র ধারায় চোখের পানি ফেলেছিলেন। চার. সাইয়্যিদাতু
নিসায়ি আহ্লিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা,
নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর পর খুবই কেঁদেছিলেন। পাঁচ. হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন
আলাইহিস সালাম কারবালার ঘটনার পর অনেক কেঁদেছিলেন।
_______________________________________________________________________________________
৪ মুহররমুল হারাম শরীফ, ১৪৩৯ হিজরী
২৭ রবি’, ১৩৮৫ শামসি
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ঈসায়ী
ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার)
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ঈসায়ী
ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার)
No comments