কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস-৭
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
জিহাদের ময়দানে গমন
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁবুর
অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছেলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন
আলী আওসাত আলাইহিস সালাম, যিনি মারাত্মক রোগ ও
জ্বরে ভুগছিলেন, হেলিয়ে দুলিয়ে কোন মতে আব্বাজানের
সামনে এসে আরজ করলেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন,
আমিও শাহাদাত বরণ করতে চাই। তিনি নিজের অসুস্থ ছেলেকে সান্ত¡না দিলেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, যাইনুল
আবিদীন! তোমাকেও যদি বিদায় দিই, তাহলে ইমাম হুসাইন
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ‘সিলসিলা’ কার থেকে জারি হবে? বাবা শোন! তোমার থেকেই
আমার বংশের ‘সিলসিলা’ জারি হবে।
আমি দুআ করছি, আল্লাহ পাক তোমাকে জীবিত রাখুন এবং তোমার
থেকে আমার বংশধরের ‘সিলসিলা’ জারি
রাখুন। তিনি উনাকে বাতিনী খিলাফত ও ইমামত প্রদান করলেন। উনাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে
বাতিনী নিয়ামত প্রদান করলেন এবং কিছু ওছীয়ত করার পর ফরমালেন, প্রিয় বৎস! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনা শরীফ-এ পৌঁছার যদি সৌভাগ্য হয়,
তাহলে সবার আগে তোমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার রওযা শরীফ-এ গিয়ে সর্বপ্রথম আমার সালাম বলবে এবং কারবালায় তোমার দেখা সমস্ত
ঘটনা উনাকে শুনাবে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বীর
বিক্রম আক্রমণ
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ইয়াযীদী
বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, দেখ, আমি কে? আমি হলাম জান্নাতের যুবকদের
সাইয়্যিদ। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁকে
রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন এবং বলতেন, এটা আমার ফুল। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁর মা সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁর পিতা হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু, যিনি খাইবর বিজয়ী। আমি ঐ হুসাইন
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যখন আল্লাহ পাক উনার নবী
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদারত অবস্থায় থাকতেন, আমি উনার পিঠ মুবারকের উপর সওয়ার হয়ে যেতাম আর তখন উনি সিজদাকে
দীর্ঘায়িত করতেন। ওহে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘরকে
উচ্ছেদকারীরা! ওহে হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার বাগানের ফুলকে ছিঁড়ে
ছিন্ন-ভিন্ন করে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে নিক্ষেপকারীরা! এসো, আমার রক্তের দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো। আমার পিছনে আর কেউ নেই।
একমাত্র আমিই রয়েছি। এগিয়ে এসো। তখন ওরা তলোয়ার খাপ থেকে বের করে তীর উত্তোলন
করে এগিয়ে আসলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন খাপ থেকে তলোয়ার বের
করে ওদের উপর আক্রমণ করলেন, তখন ওরা মেষের মত ছুটে পালাতে
লাগলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তলোয়ার বিদ্যুৎ বেগে ওদের উপর
চলতে শুরু করলো এবং ওদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনভাবে পতিত হতে লাগলো
যেমন শীতকালে বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। শেরে খোদার আওলাদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
লাশের স্তূপ করে ফেললেন। তিনি নিজে তীরের আঘাতে জর্জরিত এবং তিনদিনের তৃষ্ণায়
কাতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তলোয়ার ‘যুলফিকার’ তখনও সেই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল, যেভাবে
বদরের যুদ্ধে দেখিয়েছিল। বদরের যুদ্ধে এ তলোয়ার যখন শেরে খোদা হযরত আলী
র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হাতে ছিল এবং
চালানো হচ্ছিল, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসছিল- ‘লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লা যুল্ফিকার’
অর্থাৎ ‘ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু উনার মত যেমন কোন জওয়ান নেই, তেমনি ‘যুলফিকার-এর মত কোন তলোয়ার নেই।’ বদর যুদ্ধের
ন্যায় কারবালার ময়দানেও সেই তলোয়ার নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল।
মোট কথা, হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম লাশের স্তুপ করে ফেললেন। ইয়াযীদী বাহিনীকে কেটে কেটে
মাটি রঞ্জিত করে ফেললেন। একদিকে তিনি যেমন অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে কচুকাটা করে
ছিলেন অন্যদিকে ওরাও উনাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললো।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আনহু উনার
শাহাদাত
ইয়াযীদী বাহিনীর মারাত্মক পরিণতির কথা
উপলব্ধি করে আমর বিন সা’আদ নির্দেশ দিল,
সবাই মিলে চারিদিক থেকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য
করে তীর নিক্ষেপ করো। নির্দেশমত ইয়াযীদী বাহিনী উনাকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির
মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো। ফলে চারিদিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস
সালামকে আঘাত হানতে লাগলো। কোনটা ঘোড়ার গায়েও লাগছিল, কোনটা
উনার নিজের গায়ে পড়ছিল। এভাবে যখন তীরের আঘাতে উনার পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে
ফিনকি দিয়ে সারা শরীর মুবারক থেকে রক্ত বের হতে লাগলো। তখন উনি বার বার মুখে হাত
দিয়ে বললেন, বদবখতের দল! তোমরাতো তোমাদের নবী পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার লেহাজও করলে না। তোমরা নিজের নবী
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধরকে কতল করছো! এভাবে যখন তিনি আর একবার
মুখের উপর হাত দিলেন, তাঁর চোখের সামনে আর এক দৃশ্য ভেসে
উঠল। তিনি দেখতে পেলেন, স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত মুবারকে একটি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আলী
র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত ফাতিমাতুয্্
যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাও পার্শ্বে আছেন আর বলছেন, ‘হুসাইন! আমাদের দিকে তাকাও, আমরা তোমাকে নিতে
এসেছি।’
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই রক্ত
বোতলে ভরে নিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ পাক!
হুসাইনকে পরম ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করুন।’ নবী পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে
গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে পড়লেন এবং আঘাতে
আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস
সালাম ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহ পাক উনার আরশ দুলতে
লাগলো, হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার আত্মা
মুবারক যেন ছটফট করতে লাগলো, হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু
ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার রূহ মুবারক থেকে যেন ‘আহ’ শব্দ উচ্চারিত হলো। সেই হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম যমীনে পড়ে গেলেন, যাকে প্রিয় নবী
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কাঁধ মুবারকে নিতেন। ঘোড়া থেকে পড়ে
যাওয়ার পর কমবখ্্ত সীমার, হাওলা বিন ইয়াযীদ, সেনান বিন আনাস প্রমুখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারকের উপর চেপে বসলো। সীমার বুকের উপর বসলো। হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার
নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন, ‘এক
হিংস্র কুকুর আমার আহলে বাইতের রক্তের উপর মুখ দিচ্ছে’, আমার
নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা মুবারক নির্ঘাত সত্য, তুমিই আমাকে শহীদকারী। আজ জুমুয়ার দিন। এ সময় লোকেরা আল্লাহ পাক উনার
দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করো, যখন আমিও সিজদারত থাকি।’
আল্লাহু আকবর! দেখুন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম জীবন সায়াহ্নের সেই মুহূর্তেও পানি
পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, নিজের ছেলেমেয়েকে দেখার
জন্য আরজু করেননি, সেই সময়ও আকাঙ্খা বা আরজু এটাই ছিল যে,
আমার মাথা নত হলে যেন আল্লাহ পাক উনার সমীপেই নত হয়।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম সিজদায়
মাথা রাখলেন এবং سبحان ربى الاعلى ‘সুবহানা রব্বিইয়াল আ’লা’ তাসবীহ পাঠ করে বললেন, মাওলা! যদি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কুরবানী আপনার দরবারে
গৃহীত হয়, তা’হলে এর ছওয়াব নানাজান
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতের উপর বখশিশ করে দিন। হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো,
তখন উনার ঘোড়া স্বীয় কপালকে উনার রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে
চলে যেতে লাগল, তখন সীমার লোকদেরকে বলল, ঘোড়াটিকে ধরো, কিন্তু যতজন লোক ঘোড়াটি ধরতে
এগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমণ করল এবং দাঁত আর পা দিয়ে
জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতের জন লোককে এভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল,
ছেড়ে দাও, দেখি কি করে? ঘোড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না ও চিৎকার করতে লাগলো।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
শহীদী দেহ মুবারকের পার্শ্বে হযরত যয়নাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম যখন ঘোড়ার
কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন তিনি হযরত সখিনা
আলাইহিস সালাম আলাইহাকে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও,
আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবতঃ তোমার
আব্বা এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে দেখলেন, ঘোড়ার জীন
খালি এবং ঘোড়ার কপাল রক্তে রঞ্জিত। তা দেখে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম বুঝতে
পারলেন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শাহাদাত বরণ
করেছেন এবং তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন- واه حسينا
‘ওয়াহ্্ হুসাইনা’ واه غريبا
‘ওয়াহ্ গরীবা।’ তাঁর এ আওয়াজ শুনার
সাথে সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের রোল পড়ে গেলো। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম
ডাক দিয়ে বললেন, শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে যাচ্ছি।
হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার
কন্যা হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম; যার মাথার ওড়নাও কোন
অপরিচিত ব্যক্তি কখনো দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি থেকে
কখনো বের হননি, আজ পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের উপর
পর্দা ফেলে ভাইয়ের শহীদী দেহ মুবারক দেখার জন্য কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে
চললেন। যেতে যেতে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ওহে যালিমেরা! পথ
ছেড়ে দাও, আমার ভাইকে দেখতে দাও।’ ওরা বলল, আপনি উনাকে কি দেখবেন? উনার মাথা মুবারক শরীর মুবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম গিয়ে ভাইয়ের
রূহবিহীন, মস্তকবিহীন দেহ মুবারক দেখে জড়িয়ে
ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, ভাইজান! আপনিতো আমাদেরকে যালিমদের হাওলা করে চলে গেলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
শহীদী দেহ মুবারক কারবালার যমীনে পড়ে রইল। যেসব লোকেরা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস
সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারক দাফন করেছিলেন, তারা বলেছেন যে,
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারকে চৌঁত্রিশটি
বর্শার ছিদ্র , চল্লিশটা তলোয়ারের আঘাত এবং একশত একুশটি
তীরের জখম ছিল।
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম নিজের ভাইয়ের
শহীদী দেহ মুবারকের পাশে বিভোর হয়ে পড়ে রইলেন; এদিকে
হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহা, হযরত শহরবানু আলাইহাস
সালাম থেকে নিজেকে মুক্ত করে কারবালার ময়দানের দিকে অঝোর নয়নে ক্রন্দনরত
অবস্থায় ছুটে আসলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ফুফু!
আপনি কোথায়? আমার আব্বু কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু ডাক দিলেন, বেটি! এদিকে এসো,
তোমার মজলুম ফুফু তোমার আব্বুর পাশে বসে আছেন। হযরত সখিনা
আলাইহিস সালাম আলাইহা যখন নিজের আব্বাজানকে দেখলেন, চিনতে
পারলেন না। কারণ উনার সমস্ত শরীর মুবারক রক্তে রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক শরীর
থেকে বিছিন্ন ছিল। মা’ছুমা সখিনা রহমতুল্লাহি আলাইহা
আব্বাজানের দেহ মুবারকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। হযরত যয়নাব
আলাইহাস সালাম হযরত সখিনা আলাইহাস সালাম উনার হাত টেনে ধরে বললেন, মা সখিনা! ওঠ, আমি তোমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি।
আমার ভাই, আমাকে বলেছিলেন, তোমাকে
সান্ত¡না দেয়ার জন্য। উনি জোর করে হযরত সখিনা আলাইহিস
সালাম আলাইহাকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বুক মুবারক থেকে ছাড়িয়ে
তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার
অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের শহীদী দেহ মুবারক কারবালার ময়দানে পড়ে রইলো। ইয়াযীদী
বাহিনীরা, যারা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে
মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে, বাস্তবে তাদের এমন
পরাজয়ই হয়েছে যা আর কারো হয়নি। কারণ তারা চিরতরের জন্য আল্লাহ পাক উনার হাবীব
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শাফায়াত ও জান্নাত থেকে বঞ্চিত।
যাক, তারা এক রাত সেখানে অবস্থান করলো। যখন তারা শুয়ে
পড়ল, হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম মুখে পর্দা ফেলে তাঁবু
থেকে পুনরায় বের হলেন। দেখলেন, হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা
আলাইহস সালাম উনার বাগানের জান্নাতী ফুল কারবালার প্রান্তরে পড়ে রয়েছেন। নবী পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নয়নের মণি চকমক করছেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস
সালাম এক পলক সকল প্রিয়জনকে দেখলেন। ছবর ও ধৈর্যে অটল থাকা সত্ত্বেও অঝোরে কাঁদতে
লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক জনকে দেখে দেখে শেষে ভাইয়ের দেহ মুবারকের পাশে আসলেন
এবং বসে পড়ে বললেন, ‘ওহে আমার ভাইজান! আমি অসহায়,
অপারগ, ভিন-দেশের মুসাফির। মদীনা
মুনাওওয়ারা অনেক দূর। আমি কিভাবে ওখানে আপনার খবর পৌঁছাবো? আমি কিভাবে আপনার দাফন করবো?’
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম মদীনা
মুনাওওয়ারার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় হাত তুলে বলতে লাগলেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দৌহিত্র হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তকবিহীন দেহ মুবারক কাফন ও দাফন বিহীন রক্তে
রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।’ আর এদিকে রুগ্ন হযরত
যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম হাত তুলে বলছেন-
للعالـمين- ادركنى زين العابدين يارحمة
‘ইয়া রহমতাল্লিল আলামীন! আদরিকী
যাইনাল আবিদীন’ অর্থাৎ ‘হে
রহমাতুল্লিল আলামীন ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার উপর রহম করুন।’ এভাবে রাত্রি অতিবাহিত করলেন।
উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন যে, ‘হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের সময় সূর্যগ্রহণ
হয়েছিল, আসমান ঘোর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে তারকারাজি দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশ কালো থেকে
লাল বর্ণে পরিণত হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত বর্ষিত হয়েছিল। সাতদিন পর্যন্ত এ
রক্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। সমস্ত ঘর বাড়ির দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং যেসব
কাপড়ের উপর রক্ত পতিত হয়েছিল, সেসব কাপড় ছিড়ে টুকরো
টুকরো হওয়ার পরও সেই রক্তের লালিমা যায়নি। যমীনও কান্নাকাটি করেছিল। বায়তুল
মুকাদ্দাসে যে পাথরটা উঠানো হতো, সেই পাথরের নিচ থেকে
তাজা রক্ত বের হতো। পানি ভর্তি কলস রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইয়াযীদী বাহিনীরা
যখন উট যবেহ করেছিল তখন সে উটের ভিতর থেকে রক্তের পরিবর্তে আগুনের লেলিহান শিখা
বের হয়েছিল। জিনদের মধ্যেও শোক-বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর
অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
অনেক বেদনাবিধূর, রোমহর্ষক ঘটনার কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাত অপরিসীম হৃদয় বিদারক। এর কল্পনা করাও যায় না। এর
স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন-প্রাণ শিউরে ওঠে।
ইমাম পরিবারকে কূফায় আনয়ন
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
শাহাদাতের পর ইয়াযীদী বাহিনী একরাত কারবালার প্রান্তরে অবস্থান করেছিল। পরের দিন
সকালে তারা তাদের মৃতদেরকে দাফন করেছিল। কিন্তু শহীদদের দেহ মুবারকগুলো দাফন ও
কাফন বিহীন অবস্থায় যেমনি ছিল, তেমনি অবস্থায় ফেলে
রেখে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার পরিবারের অবশিষ্ট মহিলা ও শিশুদেরকে
বন্দি করে উটের উপর আরোহণ করিয়ে কূফার দিকে রওয়ানা দিল। চলতে চলতে তারা রাত্রি
বেলা কূফার কাছে গিয়ে পৌঁছল। ঐখান থেকে মাত্র দুই মঞ্জিল দূরত্বে ছিল কূফার
রাজধানী।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
মস্তক মুবারক নিয়ে ‘হাওয়া বিন ইয়াযীদ’ যখন রাত্রে কূফার রাজধানীতে এসে পৌঁছেছিল, তখন
গভর্নর ভবনের শাহী দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর জিম্মাদারী যেহেতু ওর হাতে,
সেহেতু অন্য কাউকে হস্তান্তর না করে মস্তক মুবারক তার নিজের ঘরে
নিয়ে গেল। ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি মাটির বাসনের নিচে মস্তক মুবারক রেখে দিল। ওর
স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এনেছ? সে উত্তরে হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার
মস্তক মুবারকের কথা বললো। এটা শুনে তার স্ত্রী শিউরে উঠলো এবং বলল, ‘কী জঘন্য ব্যাপার! তোমার ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে। হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে
আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মস্তক মুবারক! নবী মুস্তফা ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রের মস্তক মুবারক তুমি মাটির থালার নিচে রাখতে
পেরেছ! আফসুস! মানুষ ঘরে সোনা-চান্দি আনে, আর তুমি এনেছ
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রের ছিন্ন মস্তক মুবারক?
আর এভাবে বেয়াদবী এবং অবজ্ঞাভরে রেখে দিয়েছ! আমি তোমার মত
বদবখত্ লোকের সাথে থাকতে চাই না’- এ বলে তিনি মস্তক
মুবারকের কাছে এসে সসম্মানে তা মাটি থেকে উঠিয়ে উচ্চ স্থানে রাখলেন এবং পাশে বসে
ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় চিন্তা করতে লাগলেন, কী জানি
আমাদের ঘরে আল্লাহ তায়ালা’র কোন্ গযব নাযিল হয়। এমন
সময় তিনি কী দেখতে পেলেন, তা তার ভাষায় শুনুন- আমি
দেখলাম, আসমান থেকে ছোট ছোট সাদা পাখির আগমন হলো এবং
সেগুলো উনার মস্তক মুবারকের এদিক সেদিক উড়ছিল এবং ঘুরাঘুরি করছিল। একবার চলে যেত,
আবার আসত। সারা রাত এ অবস্থায় ছিল। আর মাঝে মধ্যে মস্তক মুবারক
থেকে এমন উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখলাম, যা আসমান
পর্যন্ত আলোকিত করে ফেলত।
ইবনে যিয়াদের নিষ্ঠুর আচরণ
রাত অতিবাহিত হওয়ার পর সকাল হলো। ইবনে
যিয়াদ সভাগৃহে আগমন করল এবং তাকে কারবালার তথাকথিত বিজয় সম্পর্কে অবহিত করল।
হাওলা বিন ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক নিয়ে একটা
পাত্রের উপর রেখে তা’ ইবনে জিয়াদের সামনে রাখল। তখন ইবনে
যিয়াদের হাতে একটি ছড়ি ছিল। সে ছড়ির মাথা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
ঠোঁট মুবারকের উপর লাগাল এবং দাঁত মুবারকের সাথে ঘষতে লাগল। সেই সময় তার সভাগৃহে
নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একজন বৃদ্ধ ছাহাবী হযরত যায়িদ বিন
হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ বেয়াদবী দেখে কেঁদে
ফেললেন এবং বলে উঠলেন, ‘হে ইবনে যিয়াদ! যে ঠোঁট এবং দাঁত
মুবারকের উপর তুমি আঘাত হানছো, খোদার কছম করে বলছি- আমি
স্বয়ং দেখেছি, সে দাঁত ও ঠোঁট মুবারকের উপর নবী করীম
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন। আর আজ তুমি সে ঠোঁট এবং দাঁত
মুবারকের সাথে বেয়াদবী করছ?’ ভর মজলিসে এ কথাগুলো বলার
কারণে ইবনে যিয়াদ খুবই রাগান্বিত হল এবং বলল, এ বৃদ্ধকে
এখান থেকে বের করে দাও। বৃদ্ধ না হলে আমি এ মুহূর্তে গর্দান দ্বিখ-িত করে ফেলতাম।
হযরত যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, ‘তোমার
জন্য আফসুস! তুমি আমাকে বৃদ্ধ হিসেবে সহানুভূতি দেখালে, কিন্তু
রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শরাফতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলে
না! আমি বৃদ্ধ বলে তুমি আমাকে রেহাই দিলে, কিন্তু হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কলিজার
টুকরা ও দৌহিত্র হওয়া সত্ত্বেও কোন সমীহ করলে না!’ উনার
কথার প্রতি কোনরূপ কর্ণপাত না করে ইবনে জিয়াদের অনুচরেরা উনাকে বেত্রাঘাত করে
দরবার থেকে বের করে দিল। (নাঊযুবিল্লাহ)
ইবনে যিয়াদ দরবারে দাঁড়িয়ে কয়েকটি
দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলল। যেমন- ‘সব প্রশংসা সেই আল্লাহ’র জন্যে, যিনি দুশমনকে নাজেহাল করেছেন,
নাঊযুবিল্লাহ! যিনি দুশমনকে পরাজিত করেছেন, নাঊযুবিল্লাহ! এবং ইবনে যিয়াদকে বিজয় দান করেছেন, নাঊযুবিল্লাহ! এ ধরনের কথা সে বলছিল। সেই সময় খায়বর বিজয়ী বীরের
কন্যা হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম সেখানে কয়েদী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে
উঠলেন- ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ পাক উনার জন্যে, যিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর
হওয়ার কারণে আমাদের সম্মানিত করেছেন। আর যিনি আমাদের সম্পর্কে আয়াতে কারীমা
নাযিল করেছেন এবং আমাদের পূত-পবিত্রতার কথা ঘোষণা করেছেন।’ ইবনে যিয়াদ বলে উঠল, তুমি কি এখনও সেই কথা
বলছো! তুমি কি দেখনি তোমার ভাইয়ের কি পরিণতি হয়েছে? হযরত
যয়নাব আলাইহাস সালাম কেঁদে দিলেন এবং কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে ইবনে যিয়াদ! সেই সময় বেশি দূরে নয়, যখন
হাশরের ময়দানে একদিকে নবীয়ে দো’জাহান হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থাকবেন আর একদিকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
থাকবেন; তখন তুমি দেখবে যালিমদের কী পরিণতি হয়। আমাদের
আরজি আল্লাহ তায়ালা’র দরবারে পেশ করেছি’ এ কথাগুলো বলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
ইত্যবসরে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস
সালাম-এর প্রতি ইব্নে জিয়াদের চোখ পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করলো, এ কে? ইয়াযীদ বাহিনীরা বলল, এ হলো হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ছেলে। ইব্নে যিয়াদ বলল,
তোমরা একে কেন রেখে দিয়েছ? একে কেন কতল
করোনি? ওরা বলল, এ অসুস্থ ছিল
এবং আমাদের সাথে মোকাবেলা করতে আসেনি। এজন্য আমরা একে কতল করিনি। ইবনে যিয়াদ বলল,
একেও কতল করে দাও। আমি চাই না যে, এদের
একজনও বেঁচে থাকুক। পাপিষ্ঠ ইবনে যিয়াদ এ কথাগুলো বলার সাথে সাথে জল্লাদ তলোয়ার
নিয়ে এগিয়ে আসলো। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম
আলাইহিকে জড়িয়ে নিলেন এবং বললেন, ওহে যালিমেরা! আমাদের
সাথে কোন পুরুষ মাহরাম (আপনজন) নেই। এ একমাত্র আমাদের মাহরাম। যদি তোমরা একেও কতল
করো, আমাদের সাথে কোন মাহরাম থাকবে না। তাই তোমরা এটা
জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আমাকে কতল না করবে,
এর আগে তোমরা এর কাছেও পৌঁছতে পারবে না। যদি একে কতল করতে চাও
তাহলে প্রথমে আমাকে কতল করো। ওহে যালিমেরা! একে বাঁচতে দাও। যদি তোমরা একেও কতল
করে ফেল, তাহলে আওলাদে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার ‘সিলসিলা’ কিভাবে
জারি থাকবে? এ কথাগুলো বলার পর আল্লাহ তায়ালা ইব্নে জিয়াদের
অন্তরে এমন এক ভীতি সৃষ্টি করে দিলেন, শেষ পর্যন্ত সে তার
এ ঘৃণিত সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রইলো।
এরপর ইবনে যিয়াদ কূফা শহরে সাধারণ
সমাবেশের আয়োজন করলো এবং সমবেত লোকদের ধমকী ও হুমকী দিয়ে বলল, দেখ! যারা ইয়াযীদের বিরোধিতা করেছে, তাদের কী
পরিণতি হয়েছে। তোমরাও যদি ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলো, তাহলে তোমাদেরও একই পরিণতি হবে। সে নির্দেশ দিল, শহীদদের মস্তকসমূহ বর্শার অগ্রভাগে নিয়ে এবং আহলে বাইত-এর সদস্যদেরকে
উটের পিঠে উঠিয়ে কূফার অলিতে-গলিতে যেন ঘুরানো হয়, যাতে
লোকেরা দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং আগামীতে ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করার
সাহস না পায়। নির্দেশ মুতাবিক মহান শহীদগণের পবিত্র মস্তকসমূহ বর্শার অগ্রভাগে
উঠিয়ে কূফার অলিতে-গলিতে ঘুরানো হলো এবং সাথে আহলে বাইত-এর সেই পর্দানশীন
সম্মানিতা মহিলাগণও ছিলেন, যাদের দোপাট্টা পর্যন্ত লোকেরা
আগে কখনও দেখার সুযোগ পায়নি। দুঃখের বিষয়! আজ তাদেরকে বেপর্দাভাবে কুফার
অলিতে-গলিতে ঘুরানো হচ্ছে!
যখন তাঁদেরকে ঘুরানো হচ্ছিল তখন ঐসমস্ত
কূফাবাসী, যারা চিঠি লিখে হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালামকে দাওয়াত দিয়েছিল, যারা হযরত ইমাম মুসলিম
আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল এবং যারা বড় বড় শপথ করে
বলেছিল, ‘জান-মাল উৎসর্গ করে দিব তবুও আপনার সঙ্গ ত্যাগ
করবো না।’ যারা আহলে বাইত-এর মুহব্বতের বড় দাবিদার ছিল,
যারা নিজেদেরকে আহলে বাইত-এর প্রেমিক বলতো, সেই কূফাবাসীরা, পবিত্র মস্তকসমূহ বর্শার
অগ্রভাগে নিয়ে এবং আহলে বাইত-এর সদস্যগণকে একান্ত অমানবিকভাবে কূফার অলিতে-গলিতে
যখন ঘুরাতে দেখলো, তখন তারা নিজেদের ঘরের ছাদের উপর
দাঁড়িয়ে, কেউ ঘরের জানালার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে চিৎকার
করে কাঁদছিল।
যখন হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম তাদের এ
কান্না ও চিৎকার করতে দেখলেন, তখন তিনি উটকে থামাতে
বললেন এবং ওদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে কুফাবাসী! আজ
তোমরা কেন কান্না-রোনাজারি করছো? হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার কাছে চিঠি প্রেরণকারী ছিল কারা? উনাকে
কূফায় আসার জন্য দাওয়াত দানকারী ছিল কারা? হযরত ইমাম
মুসলিমকে যখন প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়েছিল, তখন তাঁর
হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল কারা? এবং মুখে বড় বড় কথা
বলে শপথ করে জান-মাল কুরবানী করার নিশ্চয়তা দানকারী ছিল কারা? নাফরমানরা! তোমরাইতো চিঠি লিখেছিলে, তোমরাইতো
নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে দাওয়াত করে এনেছিলে।
এরপর তোমরাইতো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলে এবং উনাদেরকে যালিমদের হাতে সোপর্দ করেছিলে,
ফলে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে
একান্ত অমানবিকভাবে শহীদ হতে হলো। আর এখন তোমরা অশ্রুপাত করছ! বিশ্বাসঘাতকের দল!
তোমরা কি মনে করেছো, তোমাদের এ অশ্রুপাতের ফলে তোমাদের
কপাল থেকে আহলে বাইত-এর রক্তের দাগ মুছে যাবে? না! কক্ষনো
তা হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তোমরা কাঁদতে থাকলেও তোমাদের ললাট থেকে এ রক্তের দাগ
মুছবে না। আমি আল্লাহ পাক উনার নিকট ফরিয়াদ করছি, তোমরা
কিয়ামত পর্যন্ত এভাবে কাঁদতে ও চিৎকার করতে থাক। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম
কথাগুলো বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
No comments