কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস-৫
ইমাম পরিবারকে অবরোধ ও ফোরাত নদীর পানি পান করতে বাধা
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন
ইয়াযীদ বাহিনীকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে, তোমাদের পক্ষ থেকে যে
ব্যবস্থাই তোমরা নেও না কেন আমি কিছুতেই ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবো না।
তখন ইয়াযীদ বাহিনীর মনোভাব এত জঘন্য রূপ ধারণ করল যে, তারা
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার প্রিয়জনদের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে
দিল। সেদিন ছিল ৭ই মুর্হরম ৬১ হিজরী। ইয়াযীদ বাহিনী প্রায় চার হাজার সৈন্য ফোরাত
নদীর তীরে নিয়োজিত করলো। এদের মধ্যে দুই হাজার ছিল ‘স্থল
বাহিনী’ আর দুই হাজার ছিল ‘অশ্বারোহী’।
তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উনাদেরকে যেন এক ফোঁটা পানিও
নিতে দেয়া না হয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী উনাদের জন্য তারা পানি বন্ধ করে দিল। হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিরাশিজন সঙ্গী সাথীর মধ্যে দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলেন
এবং পর্দানশীন মহিলারাও ছিলেন। তিনি শুনে আরও আশ্চর্য হয়ে
গেলেন যে, উনাদের মোকাবিলা করার জন্য বাইশ
হাজার সৈন্য এসেছে। কী আশ্চর্য! বিরাশিজনের মোকাবিলায় বাইশ হাজার সৈন্য! আবার এই
বিরাশিজনের মধ্যে শিশু ও মহিলারা রয়েছেন। অথচ উনাদের মোকাবিলায় যে বাইশ হাজার
সৈন্য তারা সবাই যুবক এবং তারা সকল প্রকারের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসেছে। এরপরও
তারা পানি বন্ধ করে দিল। কারণ, তাদের ধারণা হল যে,
উনারা যদি পানি পান করে যুদ্ধ করেন, তাহলে
সম্ভবতঃ আমরা বাইশ হাজার হয়েও কামিয়াব হতে পারবো না। তাই পানি বন্ধ করে দেয়া
হয়েছে। এটা জুলুমের উপর জুলুম ছিল।
আফসুস! ঐসব যালিমদের জন্য, যারা এমন এক মহান ব্যক্তি এবং উনার পরিবার-প্রিয়জনদের জন্যে পানি বন্ধ
করে দিল, যিনি হচ্ছেন সাকিয়ে কাওছার, শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদরের
দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম।
ঐ কুখ্যাত ইয়াযীদ বাহিনীর প্রধান নির্দেশ
দিয়েছিল যে, “মানুষ, জীব-জন্তু,
বিধর্মী, গরু-ছাগল, পশু-পাখি সবাই এই ফোরাত নদীর পানি পান করবে, তোমরা
বাধা দিও না। কিন্তু হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা আলাইহাস সালাম-এর এই ছেলে হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালামকে পানি পান করতে দিও না।” যেই ফোরাত
নদীর পানি সবারই পান করার অনুমতি ছিল, জীব-জন্তু, পশু-পাখি কারো জন্য বাধা ছিল না। কিন্তু সেই ‘ফোরাত
নদীর’ পানি পান করা থেকে বাধা দিল সাকিয়ে কাওছার,
শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে।
ইমাম পরিবারকে অবরোধ ও ফোরাত নদীর পানি পান
করতে বাধা
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন
ইয়াযীদ বাহিনীকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে, তোমাদের পক্ষ থেকে যে
ব্যবস্থাই তোমরা নেও না কেন আমি কিছুতেই ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবো না।
তখন ইয়াযীদ বাহিনীর মনোভাব এত জঘন্য রূপ ধারণ করল যে, তারা
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার প্রিয়জনদের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে
দিল। সেদিন ছিল ৭ই মুর্হরম ৬১ হিজরী। ইয়াযীদ বাহিনী প্রায় চার হাজার সৈন্য ফোরাত
নদীর তীরে নিয়োজিত করলো। এদের মধ্যে দুই হাজার ছিল ‘স্থল
বাহিনী’ আর দুই হাজার ছিল ‘অশ্বারোহী’।
তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উনাদেরকে যেন এক ফোঁটা পানিও
নিতে দেয়া না হয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী উনাদের জন্য তারা পানি বন্ধ করে দিল। হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিরাশিজন সঙ্গী সাথীর মধ্যে দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলেন
এবং পর্দানশীন মহিলারাও ছিলেন। তিনি শুনে আরও আশ্চর্য হয়ে
গেলেন যে, উনাদের মোকাবিলা করার জন্য বাইশ
হাজার সৈন্য এসেছে। কী আশ্চর্য! বিরাশিজনের মোকাবিলায় বাইশ হাজার সৈন্য! আবার এই
বিরাশিজনের মধ্যে শিশু ও মহিলারা রয়েছেন। অথচ উনাদের মোকাবিলায় যে বাইশ হাজার
সৈন্য তারা সবাই যুবক এবং তারা সকল প্রকারের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসেছে। এরপরও
তারা পানি বন্ধ করে দিল। কারণ, তাদের ধারণা হল যে,
উনারা যদি পানি পান করে যুদ্ধ করেন, তাহলে
সম্ভবতঃ আমরা বাইশ হাজার হয়েও কামিয়াব হতে পারবো না। তাই পানি বন্ধ করে দেয়া
হয়েছে। এটা জুলুমের উপর জুলুম ছিল।
আফসুস! ঐসব যালিমদের জন্য, যারা এমন এক মহান ব্যক্তি এবং উনার পরিবার-প্রিয়জনদের জন্যে পানি বন্ধ
করে দিল, যিনি হচ্ছেন সাকিয়ে কাওছার, শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদরের
দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম।
ঐ কুখ্যাত ইয়াযীদ বাহিনীর প্রধান নির্দেশ
দিয়েছিল যে, “মানুষ, জীব-জন্তু,
বিধর্মী, গরু-ছাগল, পশু-পাখি সবাই এই ফোরাত নদীর পানি পান করবে, তোমরা
বাধা দিও না। কিন্তু হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা আলাইহাস সালাম-এর এই ছেলে হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালামকে পানি পান করতে দিও না।” যেই ফোরাত
নদীর পানি সবারই পান করার অনুমতি ছিল, জীব-জন্তু, পশু-পাখি কারো জন্য বাধা ছিল না। কিন্তু সেই ‘ফোরাত
নদীর’ পানি পান করা থেকে বাধা দিল সাকিয়ে কাওছার,
শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আনহু উনার আহবান
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আনহু উনার আহবান
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন
দেখলেন যে, পানিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে,
তখন তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনীর নিকট
গেলেন এবং তাদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তিনি তাদেরকে একান্ত যুক্তির
মাধ্যমে বুঝালেন, ‘জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকো,
রক্ত দ্বারা তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো না। জেনে শুনে কোন মু’মিনকে কতল বা শহীদ করা মানে জাহান্নামকে নিজের ঠিকানায় পরিণত করা। আমি
হলাম তোমাদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্র। যে রসূল
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারই তোমরা কলেমা পড়ো। আর বর্তমানে আমি ছাড়া
তোমাদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অন্য কোন দৌহিত্র নেই। আর আমার
সম্পর্কে তোমরা ভালভাবে জানো, আমি ঐ হুসাইন, যার সম্পর্কে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
“হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামমা
বেহেশ্তের যুবকদের সাইয়্যিদ।” আমি সেই হুসাইন, যখন নিজ মায়ের কোলে ক্রন্দন করতাম, তখন
আল্লাহ তায়ালা’র প্রিয় রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, “ওগো মা ফাতিমা! ওকে
কাঁদায়োনা। কারণ ও কাঁদলে আমার খুবই কষ্ট হয়।” দেখ,
যখন আপন মায়ের কোলে আমার কান্নাটা নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার জন্য কষ্টদায়ক ছিল, এখন তোমরা যদি আমাকে
ভিন দেশে কষ্ট দাও এবং আমার রক্ত দ্বারা তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো, আমার ছেলে মেয়েদেরকে শোকাভিভূত করো, তাহলে
চিন্তা করে দেখ, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
কী কষ্ট পাবেন! আর যে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দিবে,
এর পরিণাম সম্পর্কে তোমরা পবিত্র কুরআন শরীফ-এই পড়েছো-
ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله فى الدنيا والاخرة واعد لهم عذابا مهينا
অর্থ: ‘নিশ্চয়ই
যারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দেয়,
তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ পাক উনার লা’নত এবং আল্লাহ পাক তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে
রেখেছেন।’ (সূরা আহযাব-৫৭)
যখন তিনি নিজের এ বক্তব্য অকাট্য যুক্তির
মাধ্যমে বুঝালেন যে, জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকো এবং
আমার রক্ত দ্বারা তোমাদের হাত রঞ্জিত করো না। আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি,
তোমাদের সন্তানাদি হত্যা করিনি, তোমাদের
প্রতি কোন অত্যাচার করিনি। আমিতো কূফাবাসীর আহবানে এসেছি। তারা যখন বিশ্বাসঘাতকতা
করলো তখন আমাকে চলে যেতে দাও। কিন্তু তাদের মনে অসৎ মনোভাব প্রাধান্য বিস্তার করেছিল,
তাদের কপালে জাহান্নাম অবধারিত ছিল। তাই হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার আহবান তাদের মনে কোন রেখাপাত করলো না। বরং তারা হৈ-চৈ শুরু করে
দিল এবং বলতে লাগলো, আমরা আপনার বক্তৃতা শুনতে আসিনি। হয়
ইয়াযীদের বাইয়াত গ্রহণ করুন অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। তিনি বললেন,
আমি আমার পক্ষে যা প্রমাণ করার ছিল তা প্রমাণ করলাম। যেন কাল
কিয়ামতের মাঠে তোমাদের এ কথাটুকু বলার সুযোগ না থাকে, হে
আল্লাহ পাক! আমাদের জানা ছিল না, আমাদেরকে কেউ বুঝায়নি,
তখন আর তোমরা আল্লাহ তায়ালা’র দরবারে এ
ধরনের কোন আপত্তি পেশ করতে পারবে না। এখন সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা
ইরশাদ ফরমান-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: ‘কোন
রসূল অর্থাৎ হিদায়েতকারী না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি দান করবো না।’
(সূরা বণী ইসরাইল-১৫)
অতএব, যা
প্রমাণ করার ছিল তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। এখন তোমাদের যা ইচ্ছা তা করো।
মুহররমের নয় তারিখ ইয়াযীদ বাহিনীর মধ্যে
আনন্দ-উল্লাস শুরু হয়ে গেল। এটা পূর্ণ যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বাভাস ছিল। হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁর এক সঙ্গীকে ওদের কাছে পাঠালেন এবং বললেন, ওদেরকে গিয়ে বলুন, আমাদেরকে যেন একরাত্রি
সময় দেয়। ইয়াযীদ বাহিনী এই কথাটি গ্রহণ করলো এবং এক রাত্রির সুযোগ দিলো।
কারবালার ঐতিহাসিক ১০ই মুহররম
কারবালার ঐতিহাসিক ১০ই মুহররম
হিজরী ৬১ সন, মুর্হ্রম মাসের ৯ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ দশ তারিখ রাত্রি বেলা হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সফর সঙ্গীদের সবাইকে একত্রিত করলেন এবং বললেন,
আমার প্রিয় সাথীরা! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আন্তরিকভাবে
সন্তুষ্ট। আমি তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি যে, আজ রাতে তোমরা
যে যেদিকে পার চলে যাও। এইসব ইয়াযীদী বাহিনীর লোকেরা আমার রক্ত পিপাসু। এরা
একমাত্র আমার রক্তেই পরিতৃপ্ত হবে। তোমরা চলে যাও, তোমাদের
জান বেঁচে যাবে। কিন্তু উনার সাথীদের মধ্যে একজনও যেতে রাজী হলেন না। তাঁরা বললেন,
এ নাজুক সময়ে আপনাকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে আমরা কিভাবে চলে
যেতে পারি! এ রকম পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে ফেলে আমরা চলে যাই, কাল ক্বিয়ামতের মাঠে আমরা আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কিভাবে মুখ দেখাব? না! কিছুতেই আমরা আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারি না। আমরা আপনার সাথেই
থাকবো এবং আমরা আমাদের জানকে পতঙ্গের মতো উৎসর্গ করবো।
যখন কেউই যেতে রাজি হলেন না, তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, তাহলে
শুন! যদি তোমরা আমার সাথে থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হও, তাহলে তোমরা ধৈর্য এবং আত্ম-বিশ্বাসে শিশাঢালা প্রাচীরের মতো অটল হয়ে
যাও। এমন দৃঢ় ও অটল হয়ে যাও, যেন জুলুম-অত্যাচারের
বিভীষিকা তোমাদের পদস্খলন ঘটাতে না পারে। বাতিলের সাথে মোকাবিলা করার সময়টা হলো,
আমাদের পরীক্ষার সময়। আল্লাহ তা’য়ালা
উনার বান্দাদের থেকে পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। এখন আমাদের সামনে মুছীবতের পাহাড়
অবস্থিত। সমস্ত দুঃখ-দূর্দশা আমাদেরকে ধৈর্য সহকারে অতিক্রম করতে হবে। আল্লাহ
তায়ালা’র রাস্তায় অটল থাকতে হবে এবং এভাবে অটল থেকে
শাহাদাতের শরবত পান করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ রেখে যেতে হবে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার এ কথা উনার সাথীদের মধ্যে যথেষ্ট ধৈর্য
ক্ষমতা সৃষ্টি করে দিলো। উনার সকল সাথী উনার জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত হয়ে
গেলেন এবং সকলেই শাহাদাত বরণের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে গেলেন এবং ধৈর্য ও ত্যাগ
স্বীকারের জন্য দৃঢ় পাহাড় বনে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন,
তোমরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করো। সকাল বেলা আল্লাহ পাক উনার
হুকুম যা হওয়ার তাই হবে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
সাথীরা সবাই নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলেন এবং তিনি নিজের তাঁবুতে কুরআন শরীফ
তিলাওয়াত শুরু করলেন। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে করতে তন্দ্রাভাব আসায় তিনি
কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লেন। তখন স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর
নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ এনেছেন এবং উনাকে কোলে নিয়ে
নিলেন এবং তাঁর বুকে হাত মুবারক রেখে বললেন- اللهم ات الحسين صبرا واجرا
‘আল্লাহুম্মা আতিল হুসাইনা ছব্্রাওঁ ওয়া আজ্রা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ পাক! হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুকে ধৈর্য ও পূণ্য দান করুন’ এবং হুসাইন
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আরও বললেন, ‘তোমার উপর যা
হচ্ছে, তা থেকে আমি বেখবর নই। আমি সবকিছু দেখছি। তোমার
বিরুদ্ধে যারা তলোয়ার, তীর ইত্যাদি নিয়ে এসেছে, তারা সকলেই আমার শাফায়াত থেকে বঞ্চিত।’ নূরে
মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা বলে ইমাম হুসাইন
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার অন্তরকে ধৈর্য এবং স্থিরতার খনি বানিয়ে দিলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ঘুম থেকে উঠে উনার বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার
পরিজনকে স্বপ্নের কথা শুনালেন। ফজরের নামাযের পর তিনি আল্লাহ পাক উনার কাছে
প্রার্থনা করছিলেন- ‘ইয়া আল্লাহ! আপনার রাস্তায় আমাকে
অটল রাখুন, আমাকে ধৈর্য এবং সহনশীলতা দান করুন। হে মাওলা!
জুলুম-অত্যাচারের ঝড় তুফান আমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, আপনি আমাকে অটল থাকার তাওফীক দান করুন, যেন
জুলুম-অত্যাচার আমাকে পদচ্যুত করতে না পারে।’ এভাবে তিনি মুনাজাত করছিলেন আর উনার সাথীরা আমীন, আমীন বলছিলেন।
মোটকথা, একদিকে
পিপাসাকাতর আল্লাহ তায়ালা’র নেক বান্দাগণ ধৈর্য এবং
সহনশীলতার জন্য আল্লাহ পাক উনার কাছে প্রার্থনা করছেন, অন্যদিকে
ইয়াযীদের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের মহড়া চলছে। দুর্যোগের কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল,
ইয়াযীদের সৈন্যরা লম্ফ-ঝম্ফ দিতে লাগল, তাদের মধ্যে কতেক জাহান্নামী কুলাঙ্গার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর আশে-পাশে চক্কর দিতে লাগল এবং গর্ব ও অহংকারভরে
হুঙ্কার দিয়ে বলতে লাগল, এমন কোন বাহাদুর আছ? থাকলে আমাদের মোকাবিলায় আস। ইত্যবসরে যালিমদের মধ্যে কেউ হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করল এবং মোকাবিলার জন্য
হুঙ্কার দিল।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
অনুসারীদের শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
সাথীদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তাঁরা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
তাঁদেরকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সঙ্গীরা
জিহাদের ময়দানে বীরত্ব প্রদর্শন করতে লাগলেন। তিন দিনের পিপাসাকাতর জানবাজ মর্দে
মুজাহিদগণ ক্ষুধা এবং ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছিলেন। কিন্তু ক্ষুধার্ত ও
পিপাসার্ত হলে কি হবে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
উনার সাথীরা ছিলেন ঈমানী বলে বলীয়ান। তাঁর এক একজন সঙ্গী ইয়াযীদী বাহিনীর দশজনের
থেকেও অধিক শক্তিশালী ছিলেন। প্রচ- জিহাদ শুরু হয়ে গেল এবং হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা অনেক ইয়াযীদী বাহিনীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত
নিজেরা এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম নিজের চোখের
সামনে তাঁর পঞ্চাশজন সাথীর শাহাদাত বরণ দেখলেন। এত কিছু দেখার পরও তিনি সামান্য
ধৈর্যচ্যুত হননি; বরং তিনি সঙ্গী-সাথীদের বুকে তীর
নিক্ষেপ অবলোকন করছিলেন আর বলছিলেন- رضيت بقضائك
‘রদ্বীতু বিক্বদ্বায়িকা’ অর্থাৎ মাওলা!
আমি আপনার ইচ্ছা এবং আপনার সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট।
পঞ্চাশজন সাথী শহীদ হওয়ার পর হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মুষ্ঠিমেয় আপনজন ছাড়া আর কেউই রইলো না।
হযরত হুর বিন ইয়াযীদ রিয়াহী আলাইহিস
সালাম-এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার আপন
জনের মধ্যে ভাই ছিল, ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল, ভাগিনা ছিল এবং ছেলে ছিল। তিনি কাউকে কিছু না বলে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে
ইয়াযীদের সৈন্যদের সামনে গেলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের
মধ্যে আহলে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাহায্যকারী কেউ আছো কি?
এ সঙ্কটময় মুহূর্তে আওলাদে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার সাহায্যকারী কেউ আছো কি? আহলে রসূল
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাহায্য করে বেহেশ্্তে গমনের ইচ্ছুক কেউ আছো
কি? উনার এ আহবানে ইয়াযীদী বাহিনীর হুর বিন ইয়াযীদ
রিয়াহীর অন্তরে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল। সে ঘোড়ার উপর অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো।
তার এই অবস্থা দেখে তার এক সঙ্গী জিজ্ঞাসা করলো- হুর! কি হল? তোমার এই অবস্থা কেন? তোমাকে বড়ই ব্যতিব্যস্ত
দেখাচ্ছে? আমি তোমাকে অনেক বড় বড় যুদ্ধ ময়দানে দেখেছি।
কিন্তু কোন সময় তোমাকে আমি এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু এখন তোমার
এই অবস্থা কেন? হুর বলল, কি বলবো,
আমি আমার একদিকে বেহেশ্্ত দেখছি আর এক দিকে দোযখ। মাঝখানে
অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি এবং কি করব তা চিন্তা করছি। একদিক আমাকে দোযখের দিকে
টানছে আর একদিক বেহেশ্তের দিকে আহবান করছে। এটা বলার পর পরই তিনি ঘোড়াকে চাবুক
মেরে এক নিমিষে ইয়াযীদী বাহিনী থেকে এ বলে বের হয়ে আসলেন, ‘যেতে হলে বেহেশ্তেই যাব।’ ইয়াযীদী বাহিনী
থেকে বের হয়ে হুর জোর গলায় বললেন, দেখ, জাহান্নাম থেকে আল্লাহওয়ালা বের হচ্ছে।
আসলে একজন বের হয়ে আসার দ্বারা হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হল না। আর
ইয়াযীদী বাহিনীরও হাজারের মধ্যে একজন চলে গেলে কিছু আসে যায় না। তবে আসল কথা হলো, হুর ছিল বেহেশ্তী কিন্তু অবস্থান করছিল দোযখীদের সাথে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
আধ্যাত্মিক দূরদৃষ্টি দ্বারা অবলোকন করলেন যে, জান্নাতী
দোযখীদের মধ্যে অবস্থান করছে। তাই তিনি ডাক দিলেন, উনার
মুবারক ডাকে সাড়া দিয়ে হুর ইয়াযীদী বাহিনী থেকে বের হয়ে সোজা হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার সামনে আসলেন এবং বলতে লাগলেন, ওগো
রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আওলাদ! আপনি যে ডাক দিয়েছেন, ‘এ নাজুক সময়ে আওলাদে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
সাহায্য করে বেহেশ্তে যাওয়ার মত কেউ আছে কিনা’ আমি সেই
ডাকে সাড়া দিয়ে ইয়াযীদ বাহিনী থেকে বের হয়ে এসেছি। তাই আমি যদি আজ আপনার
সাহায্যার্থে জান কুরবান করি, তাহলে সত্যিই কি আপনার
নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শাফায়াত নসীব হবে? উনি বললেন, ইনশাআল্লাহ হবে। হুর বললেন,
আপনি আমার জন্য দুয়া করুন, আল্লাহ তায়ালা
যেন আমার বিগত দিনের পাপ মাফ করে দেন এবং আমার গড়িমসিকে ক্ষমা করে দেন। আমি আপনার
পক্ষে জান কুরবান করার জন্য যাচ্ছি। এ বলে হুর কোমর থেকে তলোয়ার বের করে ইয়াযীদী
বাহিনীর সামনে গেলেন। হুরকে দেখে ইয়াযীদী বাহিনীর সেনাপতি আমর বিন সা’দ সৈন্যদেরকে বললো, দেখ, হুর ছিল আমাদের বাহিনীর সেনাপ্রধান। সে এখন আমাদের শত্রুদের হাতে হাত
মিলিয়েছে। সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তোমরা তাকে এমন শিক্ষা দাও,
যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে শিক্ষণীয় হয়ে থাকে। এরপর ইয়াযীদী
বাহিনী চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করলো। হযরত হুর রহমতুল্লাহি আলাইহিও এমন জোরে
আক্রমণ শুরু করে দিলেন যে, ইয়াযীদী বাহিনীর জন্য যেন
খোদার গযব নাযিল হলো। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
চাচাতো ভাই এবং সৎভাই-এর শাহাদাত
হযরত হুর রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শাহাদাতের
পর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সামনে হযরত আকিল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর
বংশধর হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ভাই হযরত আব্দুল্লাহ বিন আকিল
রহমতুল্লাহি আলাইহি দাঁড়িয়েছিলেন এবং অনুমতি প্রার্থনা করছিলেন। হযরত ইমাম
হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাকেও বুক মুবারকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কপালে চুম্বন করে
অনুমতি দিলেন। তিনিও যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নিজের বীরত্ব প্রদর্শন করে ইয়াযীদী
বাহিনীর অনেককে হত্যা করে পরিশেষে শাহাদাত বরণ করলেন।
এবার হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
ভাই হযরত আবু বকর রহমতুল্লাহি আলাইহি অনুমতি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর
হলেন। শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
উনার আওলাদ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণ করলেন, উনাদের বাহুতে শেরে
খোদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার শক্তি রয়েছে।
জিহাদের ময়দানে উনারা যে বীরত্বের পরিচয়
দিয়েছেন, তা কারবালার মাটিতে চিরস্মরণীয় হয়ে
রয়েছে। উনিও অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে খতম করে শেষ পর্যন্ত নিজে শাহাদাত বরণ করেন।
No comments