নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জ্যোর্তিময় উজ্জ্বল নূরানী জিসিম মুবারক উনার এক বিশেষ মু’জিযা মি’রাজ শরীফ যা আল্লাহ পাক উনার খাছ কুদরত ॥ যা আজকের বিজ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব
سبحن الذى اسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام الى
المسجد الاقصا الذى بركنا حوله لنريه من ايتنا انه هو السميع البصير.
অর্থঃ- “পবিত্র ও মহিমাময় সেই আল্লাহ
পাক যিনি উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে রাত্রের কিছু সময় ভ্রমন করিয়েছেন- মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বছা
পর্যন্ত- যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকতময় করেছি। তাঁকে আমার নিদর্শণাবলী দেখানোর জন্যে।
নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা বনী ইসরাঈল/১)
আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া অনুযায়ী
আলোচ্য আয়াত শরীফে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মিরাজ শরীফের
কথা বলা হয়েছে যা রজব মাসের ২৭ তারিখে সোমবার রাত্রিতে জাগ্রত অবস্থায় দৈহিকভাবে হয়েছিলো।
سبحن শব্দ দ্বারা সেদিকেই নির্দেশ করা হয়েছে যে, এক অতি আশ্চর্যজনক যুগান্তকারী ঘটনা সূচিত হয়েছে। আল্লাহ পাক-এর
মাহবুব عبد (যা সর্বচ্চ সম্মান
প্রকাশক) দৈহিকভাবে মিরাজ শরীফে পরিভ্রমন করেছেন। بعبده পদ ব্যবহার করে দেহ ও রূহের সমন্বয় বুঝানো
হয়েছে। মিরাজ শরীফ যদি স্বশরীরে না হয়ে নিদ্রিত অবস্থায় রূহানী হতো তবে بروح عبده বলা হতো এবং এত তীব্র উত্তেজনা দেখা দিতো
না। ক্ষীণ বিশ্বাসী মুসলমানরা মূরতাদ হয়ে যেতো না ও এক বাক্যে বিশ্বাস স্থাপন করার
জন্য হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ‘ছিদ্দীক’ উপাধীতে ভূষিত করা
হতো না।
এ সম্পর্কে খুবই সংক্ষেপে পবিত্র কুরআন
শরীফে ‘সূরা বনি ইসারাইল, সূরা নজম ও সূরা তাকবীরে’
বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিস্তারিত বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফসহ বিভিন্ন হাদীছ শরীফের গ্রন্থে বিবরণ রয়েছে।
মিরাজ শরীফ দু’টি পর্বে বিভক্ত। প্রথম
পর্বকে ইসরা বলা হয় যা মক্কা শরীফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে সংঘটিত ঘটনা পর্যন্ত এবং
দ্বিতীয় পর্বকে মিরাজ শরীফ বলা হয় যা বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুনতাহা ও আল্লাহ
পাক-এর আরশ এবং তদপরবর্তী যাবতীয় ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত।
বস্তুতঃ আজকের বিজ্ঞানের আলোকে মিরাজ
শরীফের ঘটনাটি বর্ণনা করা সম্পূর্ণভাবেই অসম্ভব। কারণ মিরাজ শরীফের ঘটনা বর্ণনা করার
মত জ্ঞানের আলো এখন পর্যন্তও বর্তমান বিজ্ঞান অর্জন করতে পারেনি। বিষয়টি বুঝতে হলে
আমাদেরকে আলোচনা করতে হবে গতি ও সময় নিয়ে যা ছিলো মিরাজ শরীফের পূর্ব শর্ত।
কারণ, আল্লাহ পাক উনার রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘বুরাক’ ও ‘রফ রফ’ নামক অতি উচ্চ বা মহাক্ষমতা সম্পন্ন নূরের বাহনে
সওয়ার হয়ে এক অকল্পনীয় দূরত্ব চোখের পলকে অতিক্রম করে সমগ্র আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে
যখন মক্কা শরীফে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন দেখলেন যাত্রাকালীন সময়ের উনার ওযূর
পানি তখনও গড়িয়ে পড়ছে। অথচ এর মধ্যে সুদীর্ঘ ২৭টি বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেছে।
অতএব, এ বিস্ময়কর ভ্রমণ গতি ও সময়ের কোন ডাইমেনশনে সম্পন্ন হয়েছিলো তার ব্যাখ্যা দেশ
ও কালের (ঝঢ়ধপব ধহফ ঃরসব) কোন তত্ত্বই দিতে অক্ষম। বিশেষ করে আইনেস্টাইনের ফিল্ড ইক্যুয়েশন, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব, ফ্রীডম্যানের গাণিতিক মডেল, হকিং এলিসের হুইমপার
তত্ত্ব,
এ্যলেন গাথের ইনফ্লেশনারী তত্ত্ব, মাইকেল গ্রীণ ও জন সোয়ার্তসের সুপার স্ট্রিং তত্ত্ব, কালুজা ক্লাইনের পঞ্চম মাত্রার টপোলজি, মিনকোত্তস্কির স্পেস টাইমের চতুর্থ মাত্রা, রীমন ও বোলাঈ লোবোচিত্তস্কির জ্যামিতি কোনটিই মিরাজ শরীফের অকল্পনীয়
বিস্ময়কর ভ্রমনের কথা বর্ণনা করার বহু পূর্বেই ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
মিরাজ শরীফের সম্পূর্ণ ঘটনাটির সাথে গতির
বিষয়টি ওতোপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। প্রথমতঃ মিরাজ শরীফে যে দূরত্ব অতিক্রম করা হয়েছিলো
তা এক কথায় অকল্পনীয়। কারণ, আমাদের এ পৃথিবী একটি
সাধারণ গ্রহ মাত্র। নভোমণ্ডলে এরূপ কোটি কোটি গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তনশীল।
পৃথিবী থেকে এক একটি গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্ব লক্ষ-কোটি আলোক বর্ষ (আলো প্রতি সেকেণ্ডে
১,৮৬,২৮৪ মাইল গতিবেগে এক
বৎসরে যে পথ অতিক্রম করে তাকে এক আলোক বর্ষ বলে)। আর এ মহাকাশ বলতে আমরা
যা বুঝি তা প্রথম আসমানের নীচে এরপর দ্বিতীয় আসমান, দ্বিতীয় আসমানের তুলনায় প্রথম আসমানের নিচে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই একটা ডিমের মতো।
এরপর তৃতীয় আসমান, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম আসমান।
পরবর্তী প্রত্যেকটি পূর্ববর্তী সবকিছুর তুলনায় একটি ডিমের মতো। এরপর কুরসী এবং আরশ
এদের তুলনায় পূর্ববর্তী সবকিছুর উদাহরণ হলো, একটা ডিমের মতো। এরপর আলমে মালাকুত, জাবারুত, লাহুত, হাহুত এর এক একটির বিশালতা ও দূরত্ব এত বেশী যে, সে সম্পর্কে চিন্তা করার পূর্বেই মানুষের চিন্তাশক্তি অবশ ও পঙ্গু হয়ে পড়ে অর্থাৎ
মানুষ তথা বিজ্ঞান এরূপ অবস্থার কথা চিন্তাও করতে পারেনা।
বর্তমান বিজ্ঞান তথা আইনেস্টাইনের মতে
সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত ফোটনরূপ আলোক কনিকাই সর্বোচ্চ গতিবেগ সম্পন্ন। অথচ এটি একটি
অত্যন্ত সীমিত ধারণা। মিরাজ শরীফে ভ্রমনে সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন যে নূরের কনিকা ব্যবহৃত
হয়েছে,
সেরূপ গতিসম্পন্ন নূরের কনিকা সম্পর্কে বর্তমান বিজ্ঞানের কোন
প্রকার ধারণা নেই। এ সকল অজানা নূরের কনারাশি কোন অবস্থায়, কোন ডাইমেনশনে ক্রিয়া করে সে সম্পর্কেও বর্তমান বিজ্ঞান কিছু
বলতে পারেনা। কিন্তু তাই বলে আমরা তার অস্তিত্বকে অস্বীকারও করতে পারিনা। কারণ যে বস্তু
বা কণিকা সম্পর্কে আমাদের কোন প্রকার ধারনাই নেই তার অস্তিত্ব অস্বীকার করার অর্থই
হলো অজ্ঞতা ও মূর্খতা। অতীতে বিজ্ঞান এরূপ মূর্খতা অনেকবারই করেছে এবং এজন্য প্রচুর
মাশুলও দিতে হয়েছে। বর্তমান বিজ্ঞান এ ব্যাপারে অনেক সর্তক কারণ সুদূর অতীত থেকে বিজ্ঞানের
নিত্য নতুন আবিস্কারকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, যে সকল কনাকে মৌলিক ধ্রুব, অবিভাজ্য ও সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন বলে মনে করা হতো বিজ্ঞানীদের পরবর্তী আবিস্কার
তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছে।
যেমন, জেরাণ্ড ফাইনবার্গ প্রোটন কণার চাইতে দ্রুত গতিসম্পন্ন টাকিয়ন কণার কথা বলেছেন।
পূর্বে প্রতিটি বস্তু কণার একটি স্বতন্ত্র নাম দেয়া সম্ভব ছিলো। যেমন, ইলেকট্রন, পোটন, নিউট্রন প্রভৃতি। অধূনা তা আর সম্ভব হচ্ছেনা
কারণ বিজ্ঞানের আবিস্কারের সাথে সাথে
বস্তু কণাগুলি এখন আর ঠিক মৌলিক বস্তু কণা হিসাবে দেখা দিচ্ছেনা। তারা দেখা দিচ্ছে, রেজোন্যান্স বা অনুরনন হিসাবে। যেমন, ফোটন, নিউট্রিনো, ইলেকট্রন, মিউআন, পাইমেসন বা পায়ন, কেমেসন বা কেয়ন, ইটামেসন, প্রোটন, নিউট্রন, ল্যাম্বডা, হাইপেরন, ক্যাসকেড হাইপেরন ইত্যাদি। এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা কোয়ার্ক নামক
কণিকার অস্তিত্বের কথা ঘোষনা করেছেন। এছাড়াও ড এবং ত কণিকার আবিষ্কার অন্যতম সাফল্য।
এ কারণে বিজ্ঞানে শেষ বলে কোন কথা নেই।
মূলতঃ এখানে আমরা নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জ্যোতির্ময় উজ্জ্বল
নূরের সত্ত্বা বা রূপকে অবলোকন করি যার কোন মেছাল নেই। যে নূর মুবারক থেকে সকল কনিকা
সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ মিরাজ শরীফের সময়কাল পৃথিবীর হিসাবে সুদীর্ঘ সাতাশ বৎসর ছিলো।
এটি আমরা সূরা মাআরিজের চার নম্বর আয়াত
শরীফের আলোকে বর্ণনা করতে পারি যেখানে বলা হয়েছে, ‘এমন এক দিনের কথা যা পৃথিবীর পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।’
আল্লাহ পাক মহা পরাক্রমশালী তিনি অসংখ্য
জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এ সকল জগৎসমূহের নিয়ম ও ডাইমেনশনের স্বরূপ সম্পর্কেও আমাদের কোন
ধারণা নেই। আমরা শুধুমাত্র চারটি ডাইমেনশন সম্পর্কে ধারনা করতে পারি। আমাদের জগতের
তিনটি ডাইমেনশন এবং বিজ্ঞানী আইনেস্টাইন ‘সময়’কে চতুর্থ ডাইমেনশনের সাথে যুক্ত করেছেন।
বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত তাদের গবেষণার মাধ্যমে
৫০৬টি ডাইমেনশনের অস্তিত্ব থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। বাকি ৫০২টি ডাইমেনশনের স্বরূপ সম্পর্কে
আমরা কিছুই জানিনা।
ফলে মিরাজ শরীফের ঘটনাটি বর্তমান বিজ্ঞানের
আলোকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। পদার্থ বিদ্যা, গণিত বিদ্যা, কোয়ন্টাম মেকানিকস, আইনেস্টাইনের ফিল্ড ইক্যুয়েশন এ অবস্থার কোন বর্ণনা দিতে পারে
না। দেশ কাল তত্ত্ব এখানে এসে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়ে।
No comments