ছাহিবে মু’জিযা, সরওয়ারে ক্বায়িনাত, সিরাজুম মুনিরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শারীরিক শক্তি এবং কুস্তি বা মল্লযুদ্ধ
ان الله على كل شئ قدير.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (সূরা বাক্বারা/২০)
মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন,
সাইয়্যিদুল
মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে
সর্ব দিক থেকে সর্ব বিষয়ে চূড়ান্ত পরিপূর্ণতা দান করেছেন। সেটা মানসিক হোক, শারীরিক হোক, অর্থাৎ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্ব বিষয়ে
পূর্ণতা দান করেছেন। যেমন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কতটুকু শারীরিক
শক্তি রয়েছে? এ সম্পর্কে কিতাবে
উল্লেখ করা হয়েছে, একজন শক্তিশালী যুবকের
যেমন শক্তি রয়েছে অনুরূপ ৪০ জন যুবকের শক্তি দান করা হয়েছে একজন নবী-রসূল আলাইহিমুস্
সালামকে। আর সাইয়্যিদুল মুরসালীন,
ইমামুল
মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্ পাক এরূপ ৪০ জন নবীর শক্তি দান করেছেন।
(সুবহানাল্লাহ্)
অর্থাৎ ৪০*৪০=১৬০০ জন শক্তিশালী যুবকের সমপরিমাণ শক্তি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামকে দান করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
হযরত
জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, ইয়াওমুল খন্দকে আমরা সমস্ত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণ মাটি খনন করছিলাম। এক পর্যায়ে আমরা এক বিরাট পাথরের সম্মুখীন হলাম। আমরা সম্মিলিতভাবে
চেষ্টা করেও পাথরটি সামান্যতম সরাতে পারলাম না এবং এটা ভাংতেও পারলাম না। পরে বিষয়টি
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলো। সংবাদ পেয়ে তিনি সেখানে তাশরীফ
আনলেন এবং একটি অস্ত্র দিয়ে পাথরটির উপর এমন এক আঘাত করলেন যে পাথরটি ভেঙ্গে চৌচির
হয়ে গেল। (সুবহানাল্লাহ্)। বর্ণিত রয়েছে যে,
সে
সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনদিন পর্যন্ত না খাওয়া ছিলেন।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত ইমাম বায়হাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত আবূ নাঈম রহমতুল্লাহি
আলাইহি থেকে বর্ণিত আছে, মক্কা শরীফে কুরাঈশ
বংশের বণী হাশিম গোত্রে এক বীর পালোয়ান ছিলো। নাম রোকনা পালোয়ান। আরবের বিখ্যাত বিশালদেহী
এই কুরাঈশ বীর দেশের বাঘা বাঘা শক্তি ধরদেরকে অনায়াশেই ধরাশায়ী করতো। এ যাবৎ কেউ তার
পিঠ মাটিতে ঠেকাতে পারেনি। এমনই এক জবরদস্ত কুস্তিগীর সে। তার আরো বড় পরিচয় সে হিংস্র
হায়েনার মতো রক্ত পিপাসু। অনেক নিরীহ মানুষের উপর সদম্ভে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ সংহার করে
চির নিদ্রায় শায়িত করেছে সে। চেনা-অচেনা সমস্ত দেশবাসী তার নাম শুনেই আঁতকে উঠতো। যমদূত
মনে করে তার চেহারা দেখেই শিউরে উঠতো। থমকে দাঁড়াতো। ভয়ে শরীর শীতল হয়ে যেত। দম বন্ধ
হয়ে আসত। না জানি কখন ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের উপর। শিশুদের সন্ধায় ঘুম পাড়াতো রোকনার ভয়
দেখিয়ে।
রোকনার পেশা ছিলো পশু পালন। তার বড় ধরনের ছাগল ও মেষের পাল ছিলো। আযম উপত্যকা ছিলো
তার পশুর চারণ ক্ষেত্র। সেখানেই সারাদিন পশু চরাতো। কট্টর মুশরিক, পৌত্তলিক রোকনা লাত, উজ্জা দেবতার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলো। এদের বিরুদ্ধে
কোন উচ্চ বাচ্য তার কাছে চরম অসহ্য ঠেকত,
তা
সে বরদাশত করতে পারত না।
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত মূর্তিপূজা ছেড়ে এক আল্লাহ্ পাক-এর
ইবাদত করতে আহবান করেন তা রোকনা পালোয়ান শুনেছিলো। প্রতিহিংসার আগুন অন্তরে জ্বললেও
প্রতিশোধের দুঃসাহসিক সুযোগ হয়নি।
একদিনের ঘটনা- প্রয়োজনবশতঃ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম আযম উপত্যকায় একা হাঁটছিলেন। নির্জন মাঠে নিঃসঙ্গ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে পেয়ে কুরাঈশ বীর রোকনা গতিরোধ করে বললো, “হে মুহম্মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি আমাদের লাত, উজ্জা দেব-দেবীর সম্পর্কে মন্দ মন্তব্য করছেন
এবং উপাসনা করেন সর্বশক্তিমান এক মাবুদের। আপনার সাথে গোত্রীয় সম্পর্ক না থাকলে এক্ষুনি
আপনার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতাম। আপনি তো আমাকে চেনেন। আমার শক্তি ও কুস্তির কলা-কৌশল
সম্পর্ক জানেন। এখন আপনি আমার সাথে মল্লযুদ্ধ লড়বেন? মল্লযুদ্ধে আপনি জয়ী হলে আপনাকে মহাপরাক্রমশালী মা’বুদের প্রেরিত
রসূল হিসেবে মেনে নিবো এবং আপনাকে মোটা তাজা ১০টি ছাগল আপনার পছন্দ মত দিবো। আর যদি
মল্লযুদ্ধে হেরে যান তাহলে আপনি আমাদের ধর্মে দাখিল হবেন। আপনি সাহায্যের জন্য আপনার
আল্লাহ্কে ডাকুন, আমি আমাদের দেব-দেবী
‘লাত’ এবং ‘উজ্জা’কে ডাকি। রোকনা হুংকার ছেড়ে হায়েনার মত শারীরিক কসরত দেখাতে লাগলো।
রোকনার হুংকারে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
চেহারা মুবারকে পেরেশানীর কোন চিহ্ন নেই। তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন মহড়া প্রদর্শন করছেননা এরূপ নির্লিপ্ত দেখে রোকনা মনে মনে বিস্মিত
হলো। ভাবলো তার মতো বিখ্যাত কুস্তিগীরের বিরুদ্ধে কুস্তি লড়বে, কি সাহস তাঁর!
পরক্ষণেই রোকনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন প্রকার সুযোগ না
দিয়েই ক্ষীপ্ত বেগে আক্রমন করে; কিন্তু হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুহূর্তের মধ্যে রোকনাকে ধরে ছোট শিশুর মতো চিৎ করে
শুইয়ে বুকের উপর জেঁকে বসলেন। আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ্
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভরে রোকনার লৌহ কঠিন বক্ষ যেন গুড়িয়ে
যাচ্ছিলো। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েও সে তার অহমিকাবশতঃ হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য
মরিয়া হয়ে দ্বিতীয়বার লড়বার খায়েশ ব্যক্ত করে। এ বারও একইভাবে পরাস্ত হয়। এভাবে তৃতীয়বারও
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে মল্লযুদ্ধে হেরে গিয়ে সে তার দেব-দেবীকে
দোষারোপ করে। রোকনা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। অপমান বোধ তার মনে পীড়া দিতে লাগলো। ভাবলো,
তবে
কি মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হক্ব? তার লাত, উজ্জা সব বাতিল, কল্পনা প্রসূত? কিন্তু দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস, দেব ভক্তি সহজে তার অন্তর থেকে ছেড়ে যাবার নয়।
আল্লাহ্ পাক-এর ইচ্ছায় যে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জয়লাভ করেছেন এ কথাও
স্বীকার করে। তার বিস্ময়ের অবধি ছিলোনা,
কারণ
তৎকালে আরব দেশে কেউই তাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়নি।
দেব-দেবী অনুরক্ত রোকনা পরাজিত হয়ে ওয়াদা মত উপহার স্বরূপ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার ছাগপাল হতে ত্রিশটি হৃষ্ট-পুষ্ট ছাগল দিতে চাইলে হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ইসলামের
দাওয়াত দেন। রোকনা তার পরাজয়কে মু’জিযা হিসেবে মনে মনে স্বীকার করে নিলেও সে
আরও একটি বিস্ময়কর মু’জিযা দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। অদূরে ডালপালা সমেত বৃহদাকৃতির
এক প্রকান্ড বাবলা বৃক্ষ ছিলো। সেটাকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডাকা
মাত্র সঙ্গে সঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যায়। এক অংশ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
নিকট এবং অপর অংশ রোকনার নিকট দ্রুত উপস্থিত হয়ে স্থির হয়। রোকনা বিস্ময়ে হতবাক। বিস্ময়ে
অভিভূত রোকনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার
করে পরক্ষণেই বৃক্ষকে পুনরায় পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার দাবী জানালে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন,
“তাহলে
তুমি কি আমার দ্বীন গ্রহণ করবে?”
রোকনা
সম্মতি জানালো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশে বৃক্ষটি আগের
অবস্থানে ফিরে গিয়ে উভয় টুকরো এক সাথে মিলে গেলো। তা এমনভাবে জোড়া লাগল যে, বিভক্তির সামান্য কোন চিহ্নও নেই। রোকনা আশ্চর্য
হয়ে অপলক নেত্রে তাকিয়ে দেখেছে এ আশ্চর্য মুজিযা! আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোকনাকে পূর্ব ওয়াদা মনে করিয়ে বললেন, “মহামহিম সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ পাক-এর রুদ্র রোষ থেকে
বাঁচতে হলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নাও।”
মুসলমান না হওয়ার কোন অজুহাত নেই এখন। থাকতেও পারেনা। কিন্তু অন্তরে লালিত আত্মঅহংকার
তাকে বাঁধা দিলো। সে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ছাগল দিয়ে বিদায় জানাতে
চাইলো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার সম্পদের প্রত্যাশী ছিলেন
না। ছাগল না নিয়ে তিনি সে স্থান ত্যাগ করলেন।
অবশ্য রোকনা তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের সুশীতল ছায়া
নীড়ে দাখিল হন। এরূপ অসংখ্য অগনিত ঘটনা ও ওয়াকেয়া
রয়েছে যা দ্বারা সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আশ্চর্য দৈহিক
শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।
No comments